মাসকয়েক আগে বেঙ্গালুরুতে যে আইপিএল নিলামটা হল, তার পর অনেকেই কলকাতা নাইট রাইডার্স টিম ম্যানেজমেন্টের কিছু সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, নিলাম থেকে ভাল ক্রিকেটার তুলতে পারেনি কেকেআর। আবার অনেক টাকা খরচ করে এমন কিছু প্লেয়ারকে আনা হয়েছে, যাদের কার্যকরিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ‘বুড়ো’ জাক কালিসকে ধরে রাখা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন। কারও কারও মত ছিল, ভারতীয় পিচে মর্নি মর্কেলের মতো পেসার সে ভাবে প্রভাব ফেলতে পারবে না।
আইপিএল সেভেনের প্রথম ম্যাচ দেখিয়ে দিল, সমালোচনার সবটা হয়তো নাইটদের প্রাপ্য ছিল না। দেখিয়ে দিল, সিদ্ধান্তগুলোর পিছনে স্রেফ টাকার হিসেব নয়, যথেষ্ট ক্রিকেটীয় জ্ঞানও ছিল।
বুধবার আবু ধাবির শেখ জায়েদ স্টেডিয়ামে প্রথমে ব্যাট হাতে মণীশ (৫৩ বলে ৬৪) আর কালিস (৪৬ বলে ৭২), পরে বল হাতে মর্কেল (১-১৬) আর পীযূষ (১-১৫) ম্যাচের উপর যথেষ্ট প্রভাব রেখে গেল। এর মধ্যে ভারতের ম্যাচগুলোয় মর্কেল কতটা কী করতে পারবে, সেটা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকার বাউন্সি উইকেটের কথা মাথায় রেখে মর্কেলকে নেওয়া হয়েছিল। তবে বুধবার ও দেখিয়ে দিল যে, আমিরশাহির পিচে ও যথেষ্ট কার্যকরী। আর এ সবের সঙ্গে সুনীল নারিনের স্পিন-জাদু তো ছিলই। গত বার আইপিএলের পর কেউ কেউ বলছিলেন, নারিনের রহস্য নাকি ব্যাটসম্যানরা ধরে ফেলেছে। বুধবার নারিনকে দেখে আমার অন্তত সেটা মনে হয়নি। চার ওভার বল করে মাত্র কুড়ি রান দিয়ে চারটে উইকেট— ওর চেনা ফর্মেই রয়েছে নারিন।
টস জিতে কলকাতা ব্যাটিং নেওয়ায় দেখলাম রোহিত খুব একটা হতাশ হল না। পরে তো বললও, অচেনা পিচে ব্যাটসম্যানদের আগে নামিয়ে দেওয়ার চেয়ে একটা ইনিংস দেখে নেওয়া ভাল। বলল, ও টস জিতলেও আগে ফিল্ডিংই করত। প্রথম ম্যাচ তো, সবাই তাই একটু সতর্ক থাকতে চাইবে। দেখে নিতে চাইবে পিচ কী রকম ব্যবহার করে।
অচেনা পিচ, অচেনা পরিবেশ আর প্রায়-নতুন টিম নিয়ে খেলতে নামা কলকাতা নাইট রাইডার্সের স্ট্র্যাটেজিটা একটু অন্য রকম ছিল। মনে হচ্ছে গম্ভীররা ঠিক করেছিল যে, প্রথম দিকে উইকেট বাঁচিয়ে খেলব। পরে বড় শটের দিকে যাব। বুধবার স্ট্র্যাটেজিটা খেটে গেল। কিন্তু রোজ রোজ কি সেটা হবে? সন্দেহ আছে। দেখুন, আইপিএল সেভেনে এটাই কেকেআরের প্রথম ম্যাচ। তাই এখন থেকেই কাটাছেঁড়া করতে বসাটা একটু বাড়াবাড়ি। তবে এটা কিন্তু ঠিক যে, পরে এই স্ট্র্যাটেজি নিয়ে ভাল করে ভাবনাচিন্তা করতে হবে নাইট টিম ম্যানেজমেন্টকে। কারণ এই ‘ধীরে খেলো’-র নীতি খারাপ দিনে ওদের ডুবিয়ে দিতে পারে।
কেন? নাইট রাইডার্স ব্যাটিং লাইন-আপটা ভাল করে দেখুন। নাইটদের ব্যাটিংয়ে প্রচুর গভীরতা আছে। বুধবারও তো সাত নম্বরে নেমে সূর্যকুমার যাদব ৫ বলে ১৩ রান করে ফেলল। কিন্তু ‘ফায়ার পাওয়ার’ বলতে যা বোঝায়, সে রকম শক্তি ওদের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে খুব একটা নেই। রাজস্থান রয়্যালসে যে ইউসুফ পাঠান খেলত, নাইট রাইডার্স তার জায়গায় যেন অন্য ইউসুফকে পেয়েছে। টানা তিন মরসুম ধরে ওকে ঘিরে যে প্রত্যাশাটা তৈরি হয়েছিল, তার প্রতিদান সে ভাবে দিতে পারেনি ইউসুফ। রবিন উথাপ্পাকেও তেমন গত বার পুণে ওয়ারিয়র্স জার্সিতে জ্বলে উঠতে দেখা যায়নি। তাই বলছি, নাইট টিমে একটা গম্ভীর আছে। একটা জাক কালিস আছে। ব্যাটসম্যান হিসেবে যাদের উপর নিঃসন্দেহে ভরসা করা যায়। কিন্তু এবি ডে’ভিলিয়ার্স বা ক্রিস গেইলের মতো বিধ্বংসী নয়। টিমে যখন এ রকম ব্যাটসম্যান বেশি, তখন নাইটদের আজকের স্ট্র্যাটেজিটা কিন্তু ফুলপ্রুফ হতে পারে না। এরা যদি ভেবে রাখে যে, আমি প্রথম ৩০ বলে ৩০ রান তুলব। পরের কুড়ি বলে পঞ্চাশ করব, তা হলে রোজ রোজ সেটা করতে পারবে না। পরের দিকে চাপে পড়ে যাবে।
ব্যর্থ গম্ভীর
যাই হোক, টুর্নামেন্ট আরও এগোলে সেটা দেখা যাবে। আপাতত উদ্বোধনী ম্যাচে কালিস-মণীশ জুটির কথা বলি। কালিসের ইনিংসটা সত্যিই দুর্দান্ত। কে বলবে এই সে দিন এই লোকটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছে! ‘ইউটিলিটি ক্রিকেটার’ শব্দটা মনে হয় কালিসের জন্যই তৈরি হয়েছে। ৪৬ বলে ৭২ রানের ইনিংসটা নিশ্চয়ই সে সব লোকের মুখ বন্ধ করিয়ে দিয়েছে, যাঁরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে কালিসের স্ট্রাইক রেট নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। আর মণীশও কী সুন্দর ভাবে কালিসকে সঙ্গত দিয়ে গেল। একে কেকেআরে ওর প্রথম ম্যাচ। তার পর ক্যাপ্টেন অত তাড়াতাড়ি আউট হয়ে যাওয়ার পরেও এতটুকু নড়বড়ে না হয়ে, ঠান্ডা মাথায় ব্যাট করে গেল মণীশ। পুণে টিমের সঙ্গে থাকার সময় ওকে যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছিল ছেলেটা একমাত্রিক। নেমেই চালাতে চায়। মনে হত, মণীশের ব্যাটিংয়ে ওই একটাই গিয়ার আছে। বুধবার দেখলাম মণীশ এখন অনেক পরিণত। প্রতিটা বল বাউন্ডারির বাইরে পাঠানোর চিন্তা ছেড়ে এখন মনে হচ্ছে খেলাটাকে বোঝার চেষ্টা করছে মণীশ।
প্রথম ম্যাচে নতুন কেকেআরকে দেখে মনে হচ্ছে, টিমের সবাই একটা খিদে নিয়ে নেমেছে। গম্ভীর, ইউসুফ, উথাপ্পা— এদের সবার সামনে এটাই কিন্তু নিজেদের প্রমাণ করে দেখানোর শেষ সুযোগ। মনে রাখবেন, পরের বছর বিশ্বকাপ। যার আগে এটাই সবচেয়ে বড় ঘরোয়া টুর্নামেন্ট। এর পর দেশের মাঠে টুর্নামেন্ট সেই নভেম্বরে। তাই জাতীয় দলে ফেরার বাড়তি তাগিদ গম্ভীর-ইউসুফদের মনে কাজ করতে বাধ্য। কালিসেরও কিন্তু বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা দলে ঢোকার একটা বাড়তি তাগিদ রয়েছে।
মুম্বই নিয়ে একটা কথাই বলব। ওদের ব্যাটিংটাকে খুব ভঙ্গুর দেখাচ্ছে। ওরা মাইক হাসির উপর বড্ড বেশি নির্ভর করছে। সেই মাইক হাসি, যে কি না আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মধ্যে বেশ কিছু দিন নেই। কোরি অ্যান্ডারসন স্পিনারদের বিরুদ্ধে কতটা কী করতে পারে, এখনও কেউ জানে না। কায়রন পোলার্ড সবে হাঁটুর চোট সারিয়ে ফিরেছে। সব মিলিয়ে মুম্বই ব্যাটিংয়ের ছবিটা সুখের নয়।
কলকাতা নাইট রাইডার্স
গম্ভীর বো মালিঙ্গা ০
কালিস ক অ্যান্ডারসন বো মালিঙ্গা ৭২
মণীশ বো মালিঙ্গা ৬৪
উথাপ্পা ক রোহিত বো জাহির ১
ইউসুফ ন.আ ৪
সাকিব ক রোহিত বো মালিঙ্গা ১
যাদব ন. আ ১৩
অতিরিক্ত ৮
মোট ২০ ওভারে ১৬৩-৫।
পতন: ৪, ১৩৫, ১৪৪, ১৪৫, ১৪৯।
বোলিং: জাহির ৪-০-২৩-১, মালিঙ্গা ৪-০-২৩-৪, অ্যান্ডারসন ৩-০-৩৩-০,
ওঝা ৪-০-৩৬-০, হরভজন ৩-০-২৫-০, পোলার্ড ২-০-১৯-০।
মুম্বই ইন্ডিয়ান্স
হাসি বো নারিন ৩
তারে ক ও বো সাকিব ২৪
রায়ডু স্টাম্প উথাপ্পা বো নারিন ৪৮
রোহিত ক কালিস বো মর্কেল ২৭
পোলার্ড ন.আ ৬
অ্যান্ডারসন বো নারিন ২
হরভজন বো নারিন ০
গৌতম স্টাম্প উথাপ্পা বো চাওলা ৭
অতিরিক্ত ৫
মোট ২০ ওভারে ১২২-৭।
পতন: ২৪, ৪০, ১০১, ১০৬, ১১৩, ১১৩, ১২২।
বোলিং: বিনয় ২-০-১৫-০, মর্কেল ৪-০-১৬-১, নারিন ৪-০-২০-৪,
সাকিব ৪-০-২৯-১, কালিস ৩-০-২৩-০, চাওলা ৩-০-১৫-১।