ইডেনে পাঠান-ঝড়ে উচ্ছ্বসিত জুহি চাওলা ও উষা উত্থুপ। ছবি: বিসিসিআই
ইউসুফ পাঠান আজ রাতে ক’টা ছয় মারলেন?
শনিবাসরীয় ইডেনে যে পঁয়ষট্টি হাজার উপস্থিত ছিল, তারা বলবে সংখ্যাটা সাত।
একেবারেই ভুল বলবে।
বাইশ গজ থেকে শুধু সাতটা উড়েছে। বাইশ গজের বাইরে অন্তত আরও তিনটে। মাঠে গোটা দুয়েক খেলেন দক্ষিণ আফ্রিকান ডেল স্টেইন। গোটা দুয়েক কাশ্মীরি রসুল। এক-আধটা কর্ণ শর্মা। মাঠের বাইরেরগুলোয় অবশ্য কোনও দেশজ ভেদাভেদ ছিল না। পুরোটাই বরাদ্দ ভারতের মিডিয়া ও সমালোচককুলের জন্য।
রাত বারোটায় ২২ বলে ৭২ করে আধ ঘণ্টায় ‘অতিমানব’ হয়ে যাওয়া কোনও ক্রিকেটার যদি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়, স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত? সে হাসবে, বারবার হাসবে, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নিজেই মিডিয়াকে বলবে সে এই ইনিংসটা কাকে উৎসর্গ করছে। রাত বারোটায় ইউসুফ পাঠান নামের যে ক্রিকেট-কসাই সাংবাদিকদের সামনে এলেন, তাঁর প্রতিক্রিয়া এর একটাও নয়। হাসি নেই, দীর্ঘ দিনের অপমানের ‘শোধ’ তোলার ইচ্ছে আছে। হাবেভাবে মিডিয়াকে বুঝিয়ে দেওয়া আছে যে, তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে পারো। কিন্তু আমি এখনও বেঁচে আছি। আর কেমন সেই প্রতিশোধ-পর্ব? তিনটে নমুনা নীচে তুলে দেওয়া হল।
আপনি কি প্রথম বল খেলার সময় থেকেই ভেবে নিয়েছিলেন, প্লে-অফটা ইডেনে খেলবেন?
“প্রথম বল? প্রথম বলে যদি আউট হয়ে যেতাম, আপনারাই গালাগালি দিতেন। বলতেন, এ তো কিছুই খেলতে পারে না। আমি একটা জিনিস জানতাম। যদি ম্যাচটা পনেরো ওভারের মধ্যে শেষ করতে পারি, তা হলে ফাইনালে ওঠার দুটো সুযোগ পাব। টিমের উপর চাপ অনেক কমবে।”
তিন বছর ধরে যখন কেকেআরে আপনার খারাপ সময় চলছিল, নিজের বিশ্বাসটা কী ভাবে ঠিক রাখতেন?
“আরে লোকে তো বলেই। তাদের তো আর খোঁজ রাখতে হয় না যে, যখন ক্রিকেট থাকে না তখন সারা বছর ইউসুফ পাঠান কী করে। কতটা খাটে। লোকে কী বলে, সে সব নিয়ে আমি ভাবি না। ওরা জানে না ইউসুফ পাঠান পড়াশোনা করে তবে পরীক্ষায় নেমেছিল। কী করা যাবে, ওরা কথা বলার জন্য টাকা পায়। আমি টাকা পাই খেলার জন্য। টিমকে জেতানোর জন্য।”
ফর্ম ফিরে পেতে পেতে কি আপনার একটু দেরি হল? আর ক’টা ম্যাচ আগে হলে আরও ভাল হত না?
“নাহ, আগে হয়ে কী হবে? বরং যখন দরকার তখন ফর্ম ফিরে পেলাম। আগে সেটা হলে কী আর ফায়দা ছিল? আর একটা কথা। আমি কিন্তু পরের ম্যাচেও এ ভাবেই বোলারের মাথার উপর চড়ব। বল আমার জায়গায় পড়লে শেষ করে ছাড়ব। তাতে লোকে কী বলল না বলল, আমার কিচ্ছু এসে যায় না।”
যে ইনিংস শুধু কেকেআর নয়, বিপক্ষ ডাগআউটকেও বিহ্বল করে ছেড়েছে। সিএসকের জয়ে ঝিমিয়ে পড়া সিএবি কর্তাদের মাঝরাতে প্লে-অফ নিয়ে মহানন্দে স্ট্র্যাটেজি টেবলে বসিয়ে দিয়েছে। ডারেন স্যামিকে দেখা গেল বিস্ময়ে কথা বেরোচ্ছে না। কষ্টের হাসি হেসে বলে গেলেন, “ইস, ও রকম কয়েকটা শট যদি আমিও খেলতে পারতাম!” টম মুডি আবার দার্শনিক। তাঁর মনে হচ্ছে, বিশ্বের কোনও মাঠ ইউসুফকে আটকে রাখার মতো বড় নয়। গৌতম গম্ভীর ইহজন্মে এই জিনিস দেখেননি। ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করছেন আর কোনও দিন দেখবেন কি না। রবিন উথাপ্পার মতো মারমার কাটকাটকেও বলতে শোনা গেল, তিনি নন। রানটা তোলার জন্য তাঁর ইউসুফের উপরই ভরসা বেশি ছিল।
রাতের দিকে জনা দুয়েক সিএবি কর্তা স্ফূর্তি সহকারে বলছিলেন, সিএসকের জয়ে মঙ্গলবারের প্লে-অফে আতসবাজি ফাটানোর যে পরিকল্পনা সন্ধেয় বাদ দিতে হয়েছিল, বলতে হয়েছিল বোর্ড পারমিশন দিচ্ছে না, সেটাকে ফেরানোর সর্বাগ্রে চেষ্টা হবে। আর একটা পারমিশন জোগাড়ের চেষ্টাও হবে। ইডেনে কেকেআরের প্লে-অফে রাত দশটায় ডিজের জগঝম্প বন্ধ চলবে না। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের নিয়মে এক দিনের ব্যতিক্রমে কোনও ক্ষতি নেই।
নিশ্চয়ই নেই। ব্যতিক্রম ছিল বলেই ইডেনে প্লে অফ খেলবে কেকেআর। ব্যতিক্রম ঘটেছে বলেই ব্যতিক্রমী দৃশ্যগুলো দেখা গিয়েছে। দুটো হাত দু’দিকে মুঠো করে পাশবিক গর্জন করতে করতে ঘাসে প্রায় বসে পড়ছেন ইউসুফ, কেকেআরের অন্যতম মালিক জয় মেটা তাঁকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছেন গ্যালারির রেলিংয়ের দিকে, গাল টিপে দিচ্ছেন পরম আদরে, ঘাড়ে উঠে পড়ছেন গৌতম গম্ভীর, চার দিকে ‘ইউসুফ...ইউসুফ’ চিৎকারে কানের সাড়ে বারোটা, বনবন করে স্টাম্প ঘোরাতে ঘোরাতে ড্রেসিংরুমের দিকে এগোচ্ছেন পাঠান শেষ কবে এই দৃশ্যগুলো দেখা গিয়েছে? গত তিন বছর ধরে কেকেআরের হয়ে নামা মানেই সমালোচক ও মিডিয়া থেকে তাঁর জন্য বরাদ্দ থাকত কর্কশ কিছু শব্দ আর অপমান।
আজ সত্যিই ব্যতিক্রমের দিন। আজ সত্যিই ‘শোধ’ তুলে মিডিয়াকে শেষে শ্লেষ মিশিয়ে পাঠানের ‘আঘাত দিয়ে থাকলে সরি’ বলে যাওয়ার দিন।