ফিরে আসছে পঁচিশ বছর আগের কলঙ্কের ছায়া

রক্তাক্ত গোলকিপার, চিলির চক্রান্ত ও এক ফোটোগ্রাফার

অবিশ্বাস্য? অভূতপূর্ব? না সোজাসুজি ন্যক্কারজনক? সাধারণ ডিকশনারি তো বটেই, ফুটবল ডিকশনারিতেও ব্যাখ্যা করার মতো বোধহয় রূঢ় শব্দ নেই। নিঃসন্দেহে ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম বড় কলঙ্ক, যা ঘটেছিল ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সফল দলটারই সঙ্গে। আজ নয়, পঁচিশ বছর আগে। ব্রাজিলেরই গর্বের মারাকানায়। আগামী শনিবার বেলো হরাইজন্তের মাঠে যে টিমটার বিরুদ্ধে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে নামছে ব্রাজিল, কলঙ্কের ‘নায়ক’ সেই টিমই। পঁচিশ বছর আগে এক ব্রাজিল-চিলি ম্যাচে যে অপরাধ সংগঠিত হয়।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৪ ০৩:১২
Share:

অবিশ্বাস্য? অভূতপূর্ব? না সোজাসুজি ন্যক্কারজনক? সাধারণ ডিকশনারি তো বটেই, ফুটবল ডিকশনারিতেও ব্যাখ্যা করার মতো বোধহয় রূঢ় শব্দ নেই। নিঃসন্দেহে ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম বড় কলঙ্ক, যা ঘটেছিল ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সফল দলটারই সঙ্গে।

Advertisement

আজ নয়, পঁচিশ বছর আগে। ব্রাজিলেরই গর্বের মারাকানায়।

আগামী শনিবার বেলো হরাইজন্তের মাঠে যে টিমটার বিরুদ্ধে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে নামছে ব্রাজিল, কলঙ্কের ‘নায়ক’ সেই টিমই। পঁচিশ বছর আগে এক ব্রাজিল-চিলি ম্যাচে যে অপরাধ সংগঠিত হয়। যদিও সেটা বিশ্বকাপের প্রি-কোয়ার্টার ছিল না। ছিল বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনের ম্যাচ।

Advertisement

সাল: ১৯৮৯, স্থান: মারাকানা, যুদ্ধ: ব্রাজিল বনাম চিলি, ম্যাচের গুরুত্ব: যে হারবে, বিশ্বকাপ খেলবে না।

বেবেতো-দুঙ্গা-কারেকার ব্রাজিল ম্যাচে এগিয়েও গিয়েছিল এক গোলে। যখন মনে হচ্ছিল বিশ্বকাপে যাওয়া ব্রাজিলের পক্ষে শুধু সময়ের অপেক্ষা, তখনই চিলি গোলকিপারের চূড়ান্ত নোংরামি। গ্যালারি থেকে উড়ে আসা একটা পটকা চিলি কিপার রবার্তো রোজাসের মিটারখানেক দূরে পড়তে না পড়তেই দেখা যায়, রোজাস মুখ ঢেকে মাটিয়ে শুয়ে পড়েছেন। গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে তাঁর চোখের পাশ দিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে জার্সি ভিজে লাল, মাঠে ঢুকে পড়ছে চিলি টিমের মেডিক্যাল ইউনিট। ম্যাচ বন্ধ, প্লেয়ার পড়ে, ব্রাজিল ফুটবলাররা আতঙ্কিত। ব্রাজিলের হোমম্যাচে চিলি গোলকিপারকে তাক করে পটকা ছোড়া মানে শাস্তি দুঙ্গাদের ওপরেই বর্তাবে। ব্রাজিল আর নব্বই বিশ্বকাপ খেলবে না, এক গোল খেয়েও বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটিয়ে বিশ্বকাপে যাবে চিলি।

ব্রাজিল অধিনায়ক রিকার্ডো গোমস তো ঘটনাটা দেখে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না, এমন অদ্ভুত কাণ্ডের জন্য দেশের বিশ্বকাপ খেলা আটকে গেল। কিন্তু এর পরে যা ঘটল, সেটা বোধহয় ফুটবল-বিশ্বের আজও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। রোজাসের চোখে পটকা লাগেনি। গ্যালারি থেকে পটকা ছোড়াটা ইচ্ছাকৃত। যে সুযোগটা তিনি নিয়েছিলেন হাতের ব্লেড বার করে, তা দিয়ে নিজের মুখ কেটে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে। স্রেফ অন্যায় ভাবে বিশ্বকাপে যাওয়ার জন্য!

কিন্তু হাতে ক্যামেরা নিয়ে রোজাসকে আটকে দিয়েছিলেন এক ফোটোগ্রাফার! পাওলো টেক্সেইরা এখন আর ফোটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেন না। ফুটবল এজেন্ট হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেই রাতটা ভোলেননি। ২০১৪-এ দাঁড়িয়েও তাঁর বিশ্বাস হয় না, ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ইতিহাসে তাঁর এমন একটা ভূমিকা থেকে যাবে। “সে দিন পটকা উড়ে আসাটা কোনও টিভি ক্যামেরাই তোলেনি,” বলেন পাওলো। পটকাটা যখন উড়ে আসছে, সাইডলাইনে ছিলেন ফোটোগ্রাফাররা। ওখান থেকেই দেখতে পান রোজাস মাটিতে, চোখ থেকে রক্ত পড়ছে, কিন্তু পটকাটা পড়ে তাঁর চেয়ে এক মিটার দূরে। রোজাসের নোংরামি দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান ফোটোগ্রাফাররা। ব্রাজিলকে টেনে নামানোর জন্য এমন হীন মনোবৃত্তি কেউ দেখাতে পারে, সেটাই আশ্চর্যের। পাওলোর তাই সময় লেগেছিল সামলে উঠতে। “শটটা আমি মিস করেছিলাম। অন্যরাও পায়নি,” বলছেন পাওলো। স্রেফ একজন পেয়েছিলেন। রিকার্ডো অ্যালফিয়েরি নামের এক চিত্র সাংবাদিক জাপানি ম্যাগাজিনের হয়ে ছবি তুলতে এসেছিলেন মারাকানায়। পাওলো তাঁকে পাকড়াও করে জিজ্ঞেস করেন, “রিকার্ডো, তোমার কাছে পটকা ছোড়ার ছবিটা আছে?” রিকার্ডো জানিয়ে দেন, আছে। একটা নয়, চার-পাঁচটা শট।

পাওলো ওই মুহূর্তে বুঝে যান, ব্রাজিলকে যদি কেউ বাঁচাতে পারে তা হলে ওই ক’টা শট। কিন্তু সেই দুর্লভ ছবি পাওয়ার রাস্তা এতটা কঠিন হবে, ভাবতে পারেননি। অ্যালফিয়েরির কাছে ছবিগুলো চাইতে গেলে তিনি বলে দেন, ওগুলো দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ জাপানে পাঠাতে হবে। টেক্সেইরা তখন হুমকি দিয়ে বসেন, রোজাসের তঞ্চকতার প্রমাণ একমাত্র অ্যালফিয়েরির কাছেই আছে। ফিল্মগুলো না পেলে তাঁকে ব্রাজিল ছাড়তে দেওয়া হবে না।

ততক্ষণে নতুন নাটক শুরু হয়ে গিয়েছে। চিলির এক পণ্ডিত দাবি করে বসেছেন, রোজাসের ওই রক্তপাত যে পটকার জন্য, তিনি দেখেছেন। এর কিছুক্ষণ পরেই আসরে নেমে পড়েন ব্রাজিল ফুটবল প্রেসিডেন্ট রিকার্ডো টেক্সেইরা। জানতে চান, ফিল্মগুলো কার কাছে আছে। পাওলো বলেন, তাঁর কাছে। পরের চার ঘণ্টায় ঝড় উঠে যায় ব্রাজিলে। মহিলা কর্মীকে ছুটির দিনে তুলে এনে সারা রাত ধরে ফিল্মগুলো ডেভেলপ করানো হয়। মহিলা তখন ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেও ব্রাজিলের ভাগ্য ততক্ষণে ঘুরছে। এজেন্সিদের মধ্যে কাড়াকাড়ি, ছবিগুলো কে নেবে? ‘ও গ্লোবো’ শেষ পর্যন্ত কিনে নেয়। পরের দিন সকালে সারা বিশ্ব জেনে যায়, ফুটবলকে কোথায় নামিয়ে দিয়েছেন রোজাস। ফিফা যাঁকে ক্ষমা করেনি। আজীবন নির্বাসনে পাঠিয়েছে। ক্ষমা করেনি তাঁর দেশকেও। নব্বই বিশ্বকাপ তো বটেই, চুরানব্বই ওয়ার্ল্ড কাপও খেলতে পারেনি চিলি।

বিশ্বকাপে চিলির সঙ্গে খেলার সময় অপ্রীতিকর ঘটনা সে ভাবে ঘটেনি। কিন্তু দু’দেশের ফুটবল-সম্পর্কে কালো ছায়া অদৃশ্য ভাবে আজও থেকে গিয়েছে। আগামী শনিবার বেলো হরাইজন্তের দিগন্তে যেটা দেখা যেতেই পারে।

’৫০ ফাইনালের উনচল্লিশ বছর পর সে দিন যে দ্বিতীয় ‘মারাকানাজো’ ঘটতেই পারত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন