শুধু ভারত-পাকিস্তান কে বলল, ফ্লেচার বনাম বিরোধীদের ম্যাচও

সকাল সকাল দারুণ সাজানো-গোছানো পাঁচতারা হোটেলে ব্রেকফাস্ট লাউঞ্জের পরিবেশ এত ভারী হয়ে যেতে পারে কে জানত! তা-ও আপাত হাসিখুশিতে ভরা বুধবারের ঢাকার মতো রোদ্দুর ভরা দিনে!

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

ঢাকা শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৪ ০২:৫৬
Share:

সকাল সকাল দারুণ সাজানো-গোছানো পাঁচতারা হোটেলে ব্রেকফাস্ট লাউঞ্জের পরিবেশ এত ভারী হয়ে যেতে পারে কে জানত! তা-ও আপাত হাসিখুশিতে ভরা বুধবারের ঢাকার মতো রোদ্দুর ভরা দিনে!

Advertisement

ভারত-পাক ম্যাচ ঘিরে একই হোটেলে বসবাসকারী দুই দেশের ক্রিকেটারদের উপস্থিতি নিয়ে রোদ্দুরটা ঢাকলে তবু সহজবোধ্য ছিল। এটা একান্তই আন্তর্দেশীয়। যখন প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও-এ প্রাতরাশ টেবলে পাশাপাশি টেবলে পড়ে গেলেন ডানকান ফ্লেচার আর কপিল দেব!

পরস্পরে আলাপ তিরিশ বছরেরও বেশি। টানব্রিজ ওয়েলসে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের সেই অমর ১৭৫ রানের ইনিংসে বিপক্ষে জিম্বাবোয়ের যে এগারো জন খাটান দিয়েছিল, তার অন্যতম ছিলেন ফ্লেচার। কিন্তু সম্পর্ক যদি কিছু তৈরি হয়ে থাকে, সেটা যে ঘচাং ফুঃ দেখাই গেল। একটা টেবলে মুরলী কার্তিক-রোহন গাওস্করের সঙ্গে বসা কপিল। পাশেরটায় ভারতীয় সাপোর্ট স্টাফের সঙ্গে ফ্লেচার। কেউ কারও দিকে তাকালেন না পর্যন্ত। এমনিতেও কপিল আর রোহনের বাবা এত বছরের জীবনে যে গুটিকয়েক ব্যাপারে একমত হয়েছেন, তার একটা যদি হয় ঢাকার ট্র্যাফিক অসহ্য। আরও একটা হল ফ্লেচারকে এখনই কোচের পদ থেকে তাড়ানো উচিত!

Advertisement

আনন্দবাজারকে কপিল বলছিলেন, “আমি জানতে চাই ফ্লেচার কেন থাকবে আর দেশি কোচেরা কেন কোচের কাজটা পাবে না? মাপকাঠি তো হওয়া উচিত যোগ্যতা। সেটা কি ওর আছে? আমি তো আজও ভেবে পাই না লালচাঁদ রাজপুত কোচ হিসেবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দেওয়ার পরেও ওকে কেন সরানো হয়েছিল? কেন বেঙ্কটেশ প্রসাদকে বোলিং কোচের পদ থেকে হঠানো হল? কী দোষ করেছিল বেঙ্কি?”

ফ্লেচার পরিচালিত শাসনব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি নজরে আসছে কপিলের। যেমন তার মধ্যে পড়ছে মহম্মদ শামিকে টিম ম্যানেজমেন্টের সঠিক দিশা দেখাতে একাধিক বার ব্যর্থ হওয়া।

“পরপর দুটো সফরে শামি দেখলাম ভুল লাইনে বল করে গেল। সাউথ আফ্রিকা আর নিউজিল্যান্ড। ও এত ভাল সুইং করায়, অথচ অনবরত বাউন্সার দিচ্ছে। আমি তো দেখে অবাক, যে উইকেটে বাউন্স রয়েছে সেখানে তো পিচ-আপ করে বল করবি। উইকেট আপনাই তোর কাজ করে দেবে। ডারবানের মতো বাউন্সি পিচে কেউ গাঁতিয়ে শর্ট বল করে নাকি? সিরিজটাই হয়তো ঘুরে যেত শামিকে ঠিক করে গাইড করা হলে,” বললেন ক্ষুব্ধ কপিল।

কিন্তু আপনি— কপিল দেব নিজে স্পটে হাজির ছিলেন। ডাকতে পারতেন তো শামিকে। বলতে পারতেন, এই জায়গাটা শুধরে নাও।

“না, আমি সুনীলের ফর্মুলায় বিশ্বাস করি এখন। অ্যাডভাইস তখনই দেবে যদি কেউ তোমার কাছে চাইতে আসে। তা ছাড়া শামির তো কোচ আছে। ফ্লেচার আছে। আমার কিছু বলাটা ওদের বরদাস্ত না-ও হতে পারে,” বলেন কপিল। পাল্টা যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করি, কিন্তু ভারতীয় দলের অনেকেই যে একান্তে বলে, ফ্লেচার ভাল টেকনিক্যাল কোচ! কপিল আরও তেতে গেলেন। “ছাড়ুন তো। আজ টিমে রয়েছে বলে খোলাখুলি মুখ খুলতে পারছে না। দু’বছর বাদে দেখবেন এরাই কী বলে।”

বোঝাই যাচ্ছে ফ্লেচারের বিরুদ্ধে নতুন বল হাতে তিনি এবং ‘বন্ধু’ সুনীল দাঁড়িয়ে গ্যাছেন। ফার্স্ট চেঞ্জ বোলার হিসেবে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়-ও অবধারিত তৈরি থাকবেন। সৌরভ কোনও দিনই ফ্লেচারের কোচিংয়ের ভক্ত নন। শুক্রবারের পাক ম্যাচ-সহ গোটা বিশ্বকাপে ভারতীয় বিপর্যয় ঘটলে ধরেই নেওয়া যায় ফ্লেচার চৈত্রের গরমে প্রবল বাউন্সার-বৃষ্টির মধ্যে পড়বেন। ভারতীয় ক্রিকেট মিডিয়ার গোটাটাই তাঁর বিরুদ্ধে। আজ অবধি কাউকে সাক্ষাৎকার দেওয়া দূরে থাক, চারটে বাক্যও বলেননি। হর্ষ ভোগলে এ দিন বলছিলেন, “আমি ইন্ডিয়ান টিমের সঙ্গে এত কাজ করি। অথচ ফ্লেচারকে চিনি না। উনিও আমাকে চেনেন বলে হাবভাব দেখে মনে হয় না।”

প্রায় তিন বছর আগে ভারতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর একমাত্র চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয় আর অস্ট্রেলিয়াকে ৪-০ হারানো বাদ দিলে ফ্লেচার-রাজে কেবলই হাহাকারের কাহিনি। ঢাকা সেই রাস্তায় একটা খুদে স্টেশন হয়েও পরিস্থিতির বিচারে অসীম গুরুত্বের। এতই চাপ যে, এ দিন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে গুরুত্বহীন ওয়ার্ম-আপ ম্যাচটা কুড়ি রানে জিতেও কোচকে অনেকটা স্বস্তি দিয়ে গেল! ভারতীয় ডাগআউটের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে, ধোনি যত না চাপে তার চেয়ে বেশি চাপে ফ্লেচার।

আসলে মিকি আর্থারকে সরিয়ে ডারেন লেম্যান অস্ট্রেলিয়ান কোচ হওয়ার অনবদ্য পট পরিবর্তন ফ্লেচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ আরও তীক্ষ্ন করেছে। নইলে শেন ওয়াটসন কাল ওপেন মিডিয়া সেশনে যে ভাবে লেম্যানের প্রশংসা করছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল রোনাল্ডো বলছেন ফার্গুসন সম্পর্কে। “লেম্যান আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে। শৃঙ্খলাও বাড়িয়েছে। আমাদের ড্রেসিংরুমটাই কেমন বদলে গ্যাছে। আরও খাটার খিদে বাড়িয়ে দিয়েছে।” শুনতে শুনতে অদ্ভুত লাগছিল। মনে হচ্ছিল ওয়াটসনরা যেন মাইকেল ক্লার্কের ওপরে কোচকে বসিয়ে দিচ্ছেন। যেন নতুন অস্ট্রেলিয়ান কোচ ফুটবল ম্যানেজারের মতোই সর্বশক্তিমান কেউ, যিনি সব মাঠের হিসেব রিমোটে বদলে দিতে পারেন।

এমন হতমান ফ্লেচারকে ভারতীয় বোর্ড সমর্থন করে যাচ্ছে অবশ্যই কোনও এক এমএসডি-র সুপারিশে। মাঝে শোনা গেছিল ফ্লেচার যদি বা বদলান, সিএসকে কোচ এবং প্রাক্তন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক স্টিভন ফ্লেমিংকে আনা হবে। কিন্তু বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ভাল গেলে ধোনি অবধারিত পুরনো ঢেউগুলো সামলে দেবেন। ধোনির ক্যাপ্টেন্সির একটা বৈশিষ্ট্যই হল, যে যত বেশি সমালোচিত হয়, তিনি তার পাশে যেন আরও বেশি জেদ করে দাঁড়িয়ে পড়েন। নামগুলো শুধু বদলে বদলে যায়। কখনও ইশান্ত শর্মা। কখনও ডানকান ফ্লেচার। কখনও রোহিত শর্মা।

স্টার স্পোর্টস যেমন খেলা দেখানোয় নানান অভিনবত্ব নিয়ে ভাবছে। বিগ ব্যাশের মতো এলইডি প্রযুক্তি এবং আইপিএলের মতো স্পাইডার ক্যাম আজ থেকে চালু করে দিল। ভারত অধিনায়ক চাপের মুখে কখনও তাতে বিশ্বাসী নন। নইলে রোহিত শর্মাকে বসিয়ে রাহানেকে দিয়ে ওপেন করানোর আওয়াজ ক্রমশ বাড়ছে জেনেও রোহিতকে ফের ওপেন করতে পাঠাতেন না। খুব অবাক না করে রোহিত আবার ব্যর্থ। কিন্তু শুক্রবার উদ্বোধনী মহাম্যাচে মনে হয় তিনি নামবেন শিখর ধবনের সঙ্গে। আবার যুবরাজ সিংহকে না বল করানোয় তাঁকে নিয়ে এত প্রশ্ন উঠছে। ধোনি সেটাও কানে তুলতে নারাজ। ওয়ার্ম আপ ম্যাচেও তিনি এ দিন যুবরাজের জন্য এক ওভার রাখলেন না।

সফল ফাটকা খেলার জন্য ধোনির এত নাম। কিন্তু সময়-সময় তিনি হয়ে পড়েন সেই গোঁয়ারগোবিন্দ লগ্নিকারী যে সুদে অন্যত্র বেশি টাকা নিরাপদ পাওয়া যাচ্ছে জেনেও বলে, সেভিংসে কম সুদ পাওয়া যায় তো ভি আচ্ছা। ভাল সাজেশন্স নেব না...

ফ্লেচারের ওপর তাঁর লগ্নি নিয়ে এ বার পদ্মাপারে তাঁর সুদ কষাকষি কিন্তু প্রতি বারের মতো সহজ হবে কি না, সময় বলবে। বলবে যে, গোঁয়ার থেকে তিনি ফের বাঁচিয়ে দিতে পারবেন কি না মিডিয়ার সামনে নির্বাক বিদেশি কোচকে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন