সম্রাটের শাপমুক্তি, স্বপ্নের দিকে নয়া উজান

এ বারের বিশ্বকাপে লিওনেল মেসির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব দেখতে মাঝরাত্তিরের যে ফ্লাইটে রিও দে জেনেইরো থেকে সালভাদর নামলাম, তাতে প্রচুর পর্তুগাল টি-শার্ট আর পিছনে অনিবার্য ভাবে লেখা রোনাল্ডো। লাগেজ নেওয়ার সময় দেখি জার্মানি থেকে সমর্থক বোঝাই একটা ফ্লাইট সদ্য এসে নেমেছে। তাতে সব ডয়েশল্যান্ড লেখা সাদা টি-শার্ট...! ব্রাজিলে এখন সর্বত্র এমন বিশ্বকাপ-মাদকতা, কনভেয়র বেল্টের ওপরেও ক্লোজড সার্কিট টিভি আর ‘ক্যুপ দে মুন্দো’।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

সালভাদর শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৪ ০৩:১৩
Share:

আট বছরের অপেক্ষা শেষে। ছবি: গেটি ইমেজেস

এ বারের বিশ্বকাপে লিওনেল মেসির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব দেখতে মাঝরাত্তিরের যে ফ্লাইটে রিও দে জেনেইরো থেকে সালভাদর নামলাম, তাতে প্রচুর পর্তুগাল টি-শার্ট আর পিছনে অনিবার্য ভাবে লেখা রোনাল্ডো।

Advertisement

লাগেজ নেওয়ার সময় দেখি জার্মানি থেকে সমর্থক বোঝাই একটা ফ্লাইট সদ্য এসে নেমেছে। তাতে সব ডয়েশল্যান্ড লেখা সাদা টি-শার্ট...! ব্রাজিলে এখন সর্বত্র এমন বিশ্বকাপ-মাদকতা, কনভেয়র বেল্টের ওপরেও ক্লোজড সার্কিট টিভি আর ‘ক্যুপ দে মুন্দো’।

সেখানে চলছে মেসির মারাকানা গোল। গোটা জার্মানি এবং রোনাল্ডোর ‘ক্যাপটিভ অডিয়েন্স’ মাল তোলা থেকে মন সরিয়ে হাঁ করে টিভি দেখছে। লিওনেল মেসির মাপে এই গোলটা মিডিওকার। এ রকম কত গোল তিনি বার্সা-র হয়ে করে থাকেন। কিন্তু আট বছর পর এমন একটা ফুটবল-বিহ্বল সময়ে গোলটা এল বলেই হয়তো সেটা ব্রাজিল বিশ্বকাপে নতুন মহিমা যোগ করে দিয়েছে।

Advertisement

জয় এবং অধিনায়কের গোলে উচ্ছ্বসিত সাবেয়া বলেছেন, “লিও আবার দেখাল ও সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের এক জন।”

বাংলা ও ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার দেখলাম টুইট করেছেন, ‘ব্রাজিলে ফাদার্স ডে শেষ হওয়ার পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে করা গোলটা আবার বোঝাল বাবা কে!’

ইউ টিউবে ইতিমধ্যেই আঠাশ হাজারের কাছাকাছি হিট হয়ে গিয়েছে গত বারো ঘণ্টায়। স্রেফ মারাকানা গোলটা আবার ফিরে দেখতে।

আর্জেন্তিনার ফুটবল সম্রাটের শাপমোচন ঘটল ম্যাচের ৬৫ মিনিটে। বেশ দেরি করেই বলা যায়। হাফটাইম পর্যন্ত প্রেসবক্সের পাশে দশ নম্বর জার্সি পরা আর্জেন্তিনীয় সমর্থকেরা বেশ ঝিমিয়েই পড়েছিলেন। মেসি তখনও হেঁটে হেঁটে ফুটবল খেলছেন। রাইট উইংয়ে তাঁকে রেখে ৫-৩-২ ছকে শুরু করেছিল আর্জেন্তিনা। একে তো পাঁচ জন পেছনে নিয়েও সামান্যতম বসনিয়া ঝোড়ো হাওয়ায় সেই ডিফেন্স বেতসপাতার মতো কাঁপছে। তার ওপর মেসি বল নিয়ে দৌড়তেই পারছেন না। বিরতিতে বাইরে বেরিয়ে দেখি, আর্জেন্তিনার জঙ্গি সমর্থকেরও মুখ শুকনো। কেউ কেউ হাত দেখিয়ে বলছেন, দু’-দুটো ডিফেন্ডার মার্ক করছে। তিন জনও সময়-সময় আসছে। কী করে খেলবে?

তখন মনে হচ্ছিল বার্সার প্রাক্তন সহকারী কোচই জিতে গেলেন। মেসির খেলাটা আগের মতো নেই। চিরজীবন যে লোকটা দু’-তিনটে লোক নিয়ে খেলেছে, সে ভিড়কে ভয় পাবে কেন? তা ছাড়া টিভি যেটা দেখাচ্ছে না এখানে অফ দ্য বল মুভমেন্ট তো আমরা দেখতে পাচ্ছি। ক্যাপ্টেনের যেমন চাড় থাকা উচিত, সেটা দেখা যাচ্ছে না। সেন্টর সার্কলে কেমন উদাসীনের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। রাইট উইং দিয়ে হচ্ছে না। বাঁ দিকে সরে যাচ্ছেন।

মেসির দুনিয়ায় আবার আটকে গিয়ে অন্য দিকে চলে যাওয়া থাকে নাকি? তাঁর তো সেই মানসিকতা যে, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকেই লাইন শুরু। আমি যে দিকটায় আছি, সে দিকেই গোলটা হবে। আরও বিস্ময়কর, যাঁকে মেজাজ হারাতে দেখা যায় না, তিনি দি’মারিয়া একটা বল ভুল পাস করায় খিঁচিয়ে উঠলেন। চির-ঐতিহ্যের মারাকানা এ কোন মেসিকে দেখছে! এত এত লোক উপচে পড়ে এসেছে তো শুধুই তাঁকে দেখতে। তাঁর গোল দেখতে।

চ্যাম্পিয়নদের চিরকালীন সেরা লগ্ন হল ঠিক এই সময়টা। আর পাঁচ জন যা সাধারণের মানদণ্ডের ভিত্তিতে ভাবছে-টাবছে, সেটাকে লজ্জাকর পর্যায়ে নামিয়ে আনা। মেসি ম্যাজিকটাও ৬৫ মিনিটে ঘটেই গেল। বসনিয়ার তিন আর চার নম্বর ক্রমাগত ডাবল কভারিংয়ে আসছিল। গোলের সামনে অনিবার্য ভাবে এঁদের দু’জনকেই মাটি ধরিয়ে এবং ইতিহাসের সাক্ষী করে দিয়ে মেসি বিশ্বকাপে আট বছরের গোল-খরাটা কাটালেন। জার্মানি বিশ্বকাপে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে গোলটা ছিল ডান দিকে গতিতে হারিয়ে বল প্লেস করা। এটা তুলনায় অনেক দর্শনীয়। যে মেসি-রুটটা দিয়ে যেতে সারা বিশ্ব তাঁকে চেনে, সেটা দিয়েই গেলেন।

গোলটা আশ্চর্য নয়। বিস্ময়কর গোল-পরবর্তী তাঁর উৎসব প্রকাশের ধরন। গোল-পরবর্তী চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল বা লা লিগাতেও তাঁকে এত বাঁধনহারা হতে কেউ কখনও দেখেছে? কোথাও মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপে গোল না পেয়ে-পেয়ে চার দিক থেকে আসতে থাকা সমালোচনা ফুটবল মহানায়ক হয়েও তাঁকে চূড়ান্ত চাপে রেখে দিয়েছিল। এমন সাংঘাতিক চাপে ছিলেন বলেই বোধহয় কাল খেলার আগেই যে ফুটফুটে কিশোরটি ম্যাচের ম্যাসকট ছিল, তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটি দেখতে পাননি। টিম নিয়ে নামার সময় ছেলেটিকে পাশ কাটিয়ে চলে যান রেফারি র কাছে। এই কিশোরটির দুর্ভাগ্য।

কিন্তু বেলো হরাইজন্তেতে ইরান ম্যাচের যে ম্যাসকট হবে, সে মেসির হাত পাবে। আর তো তাঁর ওপর ওই আট বছরের প্রাণান্তকর চাপটা নেই। এখন আসছে স্রেফ কাপ-স্বপ্নের চাপ। সেটা অনেক বৈধ ট্যাকল। এত দিন যে চোরাগোপ্তা আক্রমণ হচ্ছিল, তা থেকে তো শাপমোচন! সেটা এত বিশ্রী পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল যে বলাবলি হচ্ছিল, দেশের হয়ে ভাল খেলবে কি, মেসি তো আর্জেন্তিনার জাতীয় সঙ্গীতটাই ভাল করে গাইতে পারে না।

১৫ জুন পরবর্তী মেসি-পৃথিবী হল নিছকই স্বপ্নের উজানে দাঁড় বেয়ে চলার। আর এখনই অবৈধ ট্যাকল নেই অপমর্যাদা করার জন্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন