Travel

মরুশহরের কোভিড ডায়েরি 

জৌলুসের অন্য নাম দুবাই। করোনার প্রকোপে কেমন ছিল এই শহর? বাড়ি বদলের ব্যস্ততার এক মাস কী করে কেটে গিয়েছে বুঝতে পারিনি। এর মধ্যে কখন করোনাভাইরাস ইউহান থেকে দুবাইয়ে থাবা বসিয়েছে, তার খবর রাখার সময় ছিল না।

Advertisement

শুভদীপ সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২০ ০৫:৪৩
Share:

বিজয়া দশমী শুভ শক্তির বিজয়ের দিন। আপামর বাঙালির মন খারাপের দিন, প্রবাসীদেরও। ফেলে আসা কলকাতার দুর্গাপুজোকে ফিরে দেখার দিন। এ বার অবশ্য পুজো কাটল লাইভ স্ট্রিমিং দেখেই। রসগোল্লা এখন দুবাইয়ের মিষ্টির দোকানেও পাওয়া যায়! ডেস্কে ল্যাপটপের পাশে রাখা ডায়েরিতে চোখ পড়ল। পড়লাম কয়েক পাতা। করোনার সঙ্গে মানিয়ে বেশ তো বাঁচতে শিখে গিয়েছি...

Advertisement

মার্চ ১৯: বাড়ি বদলের ব্যস্ততার এক মাস কী করে কেটে গিয়েছে বুঝতে পারিনি। এর মধ্যে কখন করোনাভাইরাস ইউহান থেকে দুবাইয়ে থাবা বসিয়েছে, তার খবর রাখার সময় ছিল না। রোজ অফিস যাতায়াত, তার পর সুপারমার্কেট, জিম, মল, খাওয়াদাওয়া সব তো দিব্যি বহাল... যাক, বেশি ভেবে কাজ নেই। ভরসা থাক, সুরাহা হয়ে যাবে...

মার্চ ২৬: গতকাল বিকেলে অফিসের সকলকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম ছুটির আগেই। আক্রান্তের সংখ্যাটা দশ, কুড়ি করতে করতে ছুঁয়ে ফেলেছে দেড়শো... দিন শেষ হতে না হতেই কর্পোরেট অফিসের ই-মেল এসে গেল। বাড়ি থেকে কাজ করার সম্মতি। বাড়ি ফেরার আগে কাঁচা বাজার, ফ্রোজ়েন ফুড, মশলাপাতি, স্যানিটাইজ়ার আর মাস্ক নিয়ে এসেছি মাসখানেকের মতো। ন্যাশনাল স্টেরিলাইজ়েশন প্রোগ্রাম দুই সপ্তাহের জন্য, হয়তো আরও বাড়বে। হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুবান্ধব সারা পৃথিবীর খবর দিয়ে চলেছে। কলকাতা শহরে আত্মীয় পরিজন বাবা মা, সকলের জন্যই চিন্তা। এই ভয়টা যেন কেমন অজানা! চোখে ভাসছে টিভি চ্যানেলের রিপোর্ট, ইটালির সেই ঠাকুমার কিছু না বলতে পেরে চলে যাওয়ার দৃশ্যটা।

Advertisement

এপ্রিল ১৫: সকালে একা দাঁড়িয়ে ছিলাম বারান্দায়। এপ্রিল মাস এই শহরের রঙ্গমঞ্চে টুরিস্ট সেশনের শেষ। বুর্জ খলিফার আশপাশে অনেক রোশনাই, সদয় বরুণদেব। অসময়ে এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিভেজা কালো রাস্তায় ক্রসিংয়ের দাগগুলো স্পষ্ট লাগছিল, আমার মতো তারাও বড্ড একা! মানুষ বাঁচার জন্য লড়ছে বাড়ির আশ্রয়ে থেকে। গাড়িগুলোও কি অস্তিত্ব-সঙ্কটে? ডিজিটাল দুনিয়া বেশ জেগে উঠেছে। হাতে অনেক সময়, কাজকর্মের স্বল্প বিরাম। রোজ আড্ডা হচ্ছে বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব, কাকা-পিসিদের সঙ্গে। জ়ুম মিটিংয়ের ধুম, অফিস মিটিং ক্যালেন্ডারের ফাঁকে ফাঁকেই ‘ইচ্ছে ফোন’ পৃথিবী জুড়ে নিজের মানুষদের সঙ্গে। সময় যতই দুশ্চিন্তার হোক, পেট কি কথা শোনে? আর ভাল খাওয়াদাওয়া ছাড়া বাঙালির চলেও না। তাই রান্নাঘরে যাতায়াত।

মে ৫: ওয়র্ক ফ্রম হোম পুরোপুরি কার্যকর। কাঁচা বাজার আর রসদ নিয়ে যে ভয় ছিল, কেটে গিয়েছে অনেকটাই। স্টেরিলাইজ়েশন প্রোগ্রামের সাফল্য ঘোষণা হয়েছে। দিনের বেলা সুপারমার্কেট খুলে যাওয়ায়, বাজার করার ছুতোয় কয়েক পা হেঁটে আসতে পারছি। মন্দ লাগছে না। হাতে দস্তানা, মুখে মাস্ক, সুপারমার্কেটের দরজায় জ্বর মাপতে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিয়োরিটি, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের স্টিকার আঁটা বাস স্ট্যান্ড... এ যেন নতুন পৃথিবীর ডাক। ফুড ডেলিভারি অ্যাপের মানুষগুলোকেও রাস্তায় বেশ দেখা যাচ্ছে। গত মাসেও খাবার আসতে বেশ সময় লাগছিল। কিন্তু এখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পরিষেবা মিলছে। এ দিকে চেনাজানা কয়েকজন ভাইরাসের শিকার হয়েছেন ইতিমধ্যে। প্রত্যেকেই চিকিৎসা পেয়েছেন সরকারি তত্ত্বাবধানে। ডেডিকেটেড কোভিড ট্রিটমেন্ট সেন্টারে, ড্রাইভ-ইন-টেস্টিং ফেসিলিটি আর প্রায় সব নাগরিকের টেস্ট করে ফেলার লক্ষ্যে সরকার এগিয়ে চলেছে।

জুলাই ২৫: আজ অফিস গিয়েছিলাম, পাঁচ মাস পরে। এখন সপ্তাহে তিন দিন অফিস যাওয়া। অন্য দিনে ওয়র্ক ফ্রম হোম। রাতে যাতায়াতের উপরে নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছে। সরকারি নজরদারি সর্বত্র। নতুন সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের নিয়ম না মানলেই ব্যবসা বন্ধ। মহামারিতে অনেক মানুষ জীবিকা হারালেন। মরুশহরের স্বপ্ন দেখা শেষ করে তাঁরা দেশের পথে। বন্দে ভারত। আকাশে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট দেখা যাচ্ছে ইতিউতি।

অগস্ট ৩১: বছরের এই সময়ে শহর মোটামুটি ফাঁকা হয়ে যায়। স্কুল ছুটি আর মরুভূমির গ্রীষ্মকাল। এ বার দেশে ছুটি কাটানো হল না প্রবাসী মানুষের। খুলে গিয়েছে সব মল। রেস্তরাঁয়ও বিধিনিষেধ মেনেই বেড়েছে লোকের আনাগোনা। ‘সীসা’ আর দুবাই সমার্থক প্রায়। খোলা আকাশের নীচে সীসার গন্ধ একটু ভুলে যাওয়া দুবাইকে মনে করাচ্ছে।

অক্টোবর ২৮: ৯০ লক্ষ মানুষের দেশে প্রায় ১২০ লক্ষ পিসিআর টেস্ট (অনেকের একাধিক বার টেস্ট হয়েছে) করার পরে সংক্রমণের সংখ্যা ১,২৯০০০, মৃতের সংখ্যা ৪৮৫। সারা পৃথিবীর সংক্রমণের সংখ্যার তুলনায় বেশ কম বলা চলে।

জীবনের গতি ফিরে এসেছে আবার। জনহীন রাস্তার দুঃস্বপ্নগুলো এখনও আসে, তবু বাঁচার আলোয় দিন শুরু হয়... আজ তবে এই পর্যন্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন