কলকাতা থেকে বেশি দূরে নয়, যাওয়ার পথেই থাকবে কাশফুল। এমন কোথায় ঘুরবেন? ছবি: সংগৃহীত।
মহালয়ার দিনে বেশির ভাগ বাঙালির ঘুম ভাঙে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ শুনে। কারও কারও এই দিনে তর্পণের ব্যস্ততা থাকে। কিন্তু সে সব সকালেই ফুরিয়ে যায়। দেবীপক্ষের সূচনায়, ছুটির দিনটি কি ঘরেই কাটবে? তার চেয়ে বরং বেরিয়ে পড়ুন চারচাকাকে সঙ্গী করে। রইল কলকাতা থেকে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টার দূরত্বে কয়েকটি বেড়ানোর ঠিকানা।
বর্গভীমা মন্দির
তমলুকের বর্গভীমা মন্দিরে ঘুরে আসতে পারেন মহালয়ায়। ছবি: সংগৃহীত।
দেবীপক্ষের সূচনায় ঘুরে আসতে পারেন তমলুকের বর্গভীমা মন্দিরে। কলকাতা থেকে দূরত্ব ৮৮ কিলোমিটারের মতো। তবে শুধু মন্দির দর্শন নয়, এই পথেই দেখতে পাবেন কাশফুল। ঘুরে নিতে পারেন প্রাচীন এই শহরের আনাচ-কানাচও। দেবী বর্গভীমা চতুর্ভুজা। নীচে রয়েছে শায়িত শিবের মূর্তি। মায়ের ডানহাতের উপরটিতে রয়েছে খড়্গ আর নীচেরটিতে ত্রিশূল। উপরের বাম হাতে খর্পর আর নীচের হাতে মুণ্ড। বর্গভীমার দু’পাশে শোভা পাচ্ছ দশভূজা মহিষমর্দিনী এবং দ্বিভূজা মহিষমর্দিনী মূর্তি। মনে করা হয়, বর্গভীমা মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল একাদশ বা দ্বাদশ শতক। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে দেবী বর্গভীমা তমলুক তথা পূর্ব মেদিনীপুর ও বাংলার মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি তীর্থস্থান। লোকশ্রুতি আছে, দেবীর মন্দিরের পাশে থাকা পুষ্করিণীতে ডুব দিয়ে পাওয়া যে কোনও বস্তু লাল সুতো দিয়ে মন্দিরের পার্শ্ববর্তী গাছে বাঁধলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়। এখানে তিনি কালী রূপে পূজিতা হন। তাঁকে আবার কখনও দুর্গা বা জগদ্ধাত্রী রূপেও পূজা করা হয়। প্রথা অনুযায়ী, তমলুক শহরে আজও কোনও মণ্ডপে দুর্গাপুজার ঘটস্থাপনের আগে দেবী বর্গভীমা মন্দিরে পুজো দেওয়া হয়।
তমলুকে প্রবেশের সময় মানিকতলা মোড় থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে দেখে নিন রাজবাড়ি। এখন অবশ্য তা ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। তবে রয়ে গিয়েছে মন্দির। সেখান থেকে এক কিলোমিটার গেলেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের কাহিনি স্মরণ করাবে শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ। ব্রিটিশ পুলিশ এখানেই মাতঙ্গিনী হাজরা সহ অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর গুলি চালিয়েছিল। এখান থেকে ৫০০ মিটার দূরে রয়েছে মিউজ়িয়াম। মিউজ়িয়াম থেকে বর্গভীমা মন্দিরের ১ কিলোমিটার। কাছেই রূপনারায়ণের দিকে যেতে পারেন। সেখানেও দেখা মিলবে কাশের।
কী ভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে বর্গভীমা মন্দিরের দূরত্ব ৮৮ কিলোমিটার। প্রথমে যেতে হবে কোলাঘাট। সেখান থেকে হলদিয়াগামী ৪২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে মেচেদা। সেখান থেকে রাজ্য সড়ক ধরে তমলুকের মানিকতলা মোড়। এখান থেকে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি খুব বেশি দূরে নয়। তমলুক বা মাতঙ্গিনী রেলস্টেশনে নেমেও টোটো-অটোয় জায়গাগুলি ঘুরে নেওয়া যায়।
যোগাদ্যা মন্দির
যোগাদ্যার এই মন্দিরে দেবী থাকেন নিমজ্জিত। ছবি: সংগৃহীত।
সকাল সকাল বেরিয়ে রাতে ফিরে আসতে পারেন কাটোয়ার ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা মন্দির থেকেও। শৈল্পিক সৌন্দর্য বিশেষ নেই এই মন্দিরের। তবে এই মন্দির এবং দেবীকে ঘিরে রয়েছে নানা লোককথা। সবচেয়ে বড় কথা, কলকাতা থেকে কাটোয়ার ক্ষীরগ্রামের পথে বেরিয়ে পড়লে, রাস্তার দু'পাশের সবুজ ধানের ক্ষেত মন ভরিয়ে দেবে। ইতিউতি দেখা দেবে একমানুষ সমান কাশের বন।
ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা ৫১ পীঠের অন্যতম বলে পরিচিত। এই সতীপীঠে দেবীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পড়েছিল বলে লোকমুখে প্রচারিত। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন, ‘‘ক্ষীরগ্রামে ডানি পা’র অঙ্গুষ্ঠ বৈভব/ যুগাদ্যা দেবতা ক্ষীরখণ্ডক ভৈরব’’। দেবী যোগাদ্যার ভৈরবের নাম ক্ষীরখণ্ডক। সেই থেকে এই অঞ্চলের নাম ক্ষীরগ্রাম। এখানে প্রতিষ্ঠিত দুর্গার প্রস্তরবিগ্রহ। বিগ্রহ সারা বছরই থাকে ক্ষীরদিঘির জলের তলায়। বছরের নির্দিষ্ট কয়েকটি তারিখে গভীর রাতে দেবীর মূর্তি জল থেকে তুলে এনে অল্প সময়ের জন্য মন্দিরে রাখা হয়। একমাত্র বৈশাখী সংক্রান্তিতে দেবী সূর্যের মুখ দেখেন। সে দিন দেবীদর্শনের জন্য দূরদূরান্ত থেকে ভক্তেরা এসে সমবেত হন ক্ষীরগ্রামে। তবে মহালয়ায় গিয়ে হতাশ হবেন না। প্রশস্ত চত্বরে দুই মন্দির রয়েছে। একটি মন্দিরের নীচের অংশ জলে নিমজ্জিত। মূল মূর্তি সেখানে থাকলেও আর একটি মন্দিরে রয়েছে মায়ের কৃষ্ণবর্ণ মূর্তি। সেটি বছরভর দর্শন করা যায়। সকালবেলা পৌঁছলে এখানে ভোগ খেতেও পারবেন।
যোগাদ্যার এই প্রতিমার পুজো হয় বছরভর। দর্শন পাওয়া যায় সারা বছর ছবি: সংগৃহীত।
এখান থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ওড়গ্রাম। কলকাতার এত কাছে এমন শালের জঙ্গল— না এলে বোঝা যায় না। এখানেই শুটিং হয়েছিল ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়া ‘ডাকঘর’ ওয়েব সিরিজ়টির। পায়ে হেঁটে বা গাড়ি নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে পারেন। এখানে রয়েছে পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি, যা স্থানীয় লোকমুখে ‘চাতাল’ নামেই পরিচিত।
কী ভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে ডানকুনি হয়ে গুরাপ, জৌগ্রাম থেকে মেমারি হয়ে কুসুমগ্রাম, মন্তেশ্বর হয়ে এগোতে হবে। কৈচর-কালনা রোড ধরে পৌঁছোন ক্ষীরগ্রামে। মোটামুটি তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। ক্ষীরগ্রাম থেকে দেবপুর হয়ে আসতে হবে ওড়গ্রামে।
বর্ধমান-কাটোয়া লাইনে কৈচর হল্ট স্টেশনে নেমেও অটো বা টোটোয় যোগাদ্যা মন্দির ঘুরে নেওয়া যায়।
জয়পুরের জঙ্গল
জয়পুরের জঙ্গলও কিন্তু একদিনে ঘুরে আসা যায়। ছবি: সংগৃহীত।
মহালয়ার দিন বেরিয়ে পড়ুন জয়পুর জঙ্গলের পথে। কলকাতা থেকে যাওয়ার সময়ে এই পথে পড়বে দামোদর, মুন্ডেশরী, দ্বারকেশ্বর। নদ-নদীর চর শরতের সময়ে কাশে ভরে থাকে। কাশফুলের প্রেক্ষাপটে ছবি তোলার সুবর্ণ সুযোগ মিলবে এই রাস্তায়। শহুরে পথঘাট পেরালে সঙ্গ দেবে প্রকৃতি। অরণ্যের বুক চিরে চলে যাওয়া মসৃণ পিচরাস্তায় মিলবে চোখের আরাম। চওড়া সড়ক ছেড়ে বাঁয়ে কিংবা ডাঁয়ে শালের জঙ্গলে ঢুকে পড়তে পারেন। মোরামের রাস্তা গিয়েছে অরণ্যের ভিতরে। তবে বৃষ্টি হচ্ছে এখন মাঝেমধ্যেই। জঙ্গলে সাপ থেকে সাবধান। জয়পুর জঙ্গল থেকে দেখে নিতে পারেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের একটি পরত্যক্ত বিমানঘাঁটি। জয়পুর থেকে ঘণ্টাখানেক এগোলেই পৌঁছে যাবেন বিষ্ণুপুরের রাসমঞ্চে। ঘোরা এবং ছবি তোলার জন্য— এই স্থানটিও বেশ সুন্দর। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত রাসমঞ্চের নির্মাণশৈলী মনোমুগ্ধকর।
কী ভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে ডানকুনি হয়ে হরিপাল, চাঁপাডাঙার রাস্তা ধরে এগোন। চাঁপাডাঙার কাছেই পড়বে দামোদর। নদের উপর দিয়ে পাকা ব্রিজ। আরও কিছুটা এগোলে মুন্ডেশ্বরী নদী। সে সব পার করে আরামবাগ। এই পথেই রয়েছে দ্বারকেশ্বরও।
আরামবাগ-কোতুলপুরের রাস্তা ধরে এগোতে হবে। কোতুলপুর-গোপালপুর পার করে বাঁকুড়ায় জয়পুরের জঙ্গল। কলকাতা থেকে জয়পুরের দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। যেতে সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো সময় লাগবে।
ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মস্থান বীরসিংহগ্রাম
বীরসিংহগ্রামে রয়েছে বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির। এখানে বিদ্যাসাগরের ব্যবহৃত জিনিস রাখা আছে। ছবি: সংগৃহীত।
যাঁর হাত ধরে বর্ণের সঙ্গে পরিচয়, সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মস্থানটিও কিন্তু ঘুরে আসতে পারেন। পূর্ব মেদিনীপুরের ঘাটালে সেই স্থানেই এখন তৈরি হয়েছে সংগ্রহশালা। মনীষীর কাজের প্রচার, তাঁর ভাবনা, আদর্শকে ছড়়িয়ে দিতেই নতুন ভাবে সেজে উঠেছে এই স্থান। বেশ কয়েকটি ঘর রয়েছে বাড়িটিতে। সেখানেই বিদ্যাসাগরের জীবনের নানা মুহূর্ত, কাহিনি ছবিতে, মডেলে তুল ধরা হয়েছে। রয়েছে তাঁর কিছু নিজস্ব সংগ্রহ, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, বই।
বীরসিংহ ঘুরে দেড় ঘণ্টা দূরত্বে যেতে পারেন পাথরা। কংসাবতীর পাড়ে প্রাচীন মন্দিরে টেরাকোটার নিখুঁত কাজ। মন্দিরময় পাথরায় যেন প্রতি পদে ইতিহাসের হাতছানি। মেদিনীপুর শহর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূর। ২০০৩ সালে কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত ৩৪টি মন্দির এবং মন্দির সংলগ্ন ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)। পরে ১৯টি মন্দির সংস্কার করা হয়। এখানে রয়েছে নবরত্ন মন্দির। উচ্চতা ৪৫ ফুট। পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই মন্দির সংস্কার করা হয়। যদিও পাথরা পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে এখনও লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গিয়েছে। সে ভাবে প্রচার-মাতামাতি, কোনওটাই নেই।
কী ভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে ডানকুনি, কোলাঘাট, পাঁশকুড়া, দাসপুর, ঘাটাল, পাথরা হয়ে বীরসিংহ গ্রামে পৌঁছোন। যাওয়া বা ফেরার পথে পাথরা ঘুরে নিতে পারেন। কলকাতা থেকে বীরসিংহের দূরত্ব ১২৫ কিলোমিটার। পাঁশকুড়া বা খড়্গপুর স্টেশন থেকে গাড়িতে বা বাসেও যেতে পারেন।
বর্তির বিল
বর্তির বিল। ছবি: সংগৃহীত।
কলকাতার বেশ কাছেই বর্তি। ইদানীং ফোটোশুটের জন্য বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে বারাসত এবং ব্যারাকপুরের মধ্যবর্তী জায়গাটি। টানা বর্ষায় বিল এখন কানায় কানায় পূর্ণ। ফলে, ডিঙিনৌকায় জলবিহারের এটাই সুবর্ণ সুযোগ। গ্রামীণ পরিবেশ, অনেকটা খোলা আকাশ আর প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে হলে বন্ধুবান্ধব বা যুগলে ঘুরে আসতে পারেন বর্তির বিলে। পড়ন্ত বিকেল এখানে কাটাতে ভালই লাগবে। শরতের দিনে এখানে দেখা মেলে কাশেরও।
কী ভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে গাড়িতে চলে আসুন বারাসতের ডাকবাংলো মোড়ে। সেখান থেকে চলুন হেলা বটতলা মোড়ে। এখান থেকে চলুন নীলগঞ্জ ব্যাঙ্ক মোড়। এখান থেকে বর্তির বিল খুব কাছেই। আবার ব্যারাকপুর-নীলগঞ্জ হয়েও আসতে পারেন। ব্যাঙ্কমোড় থেকে বড় গাড়ি ভিতরে ঢুকবে না। প্রয়োজন হলে গাড়ি সেখানে রেখে অটো বা টোটো ধরে গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন।