Kali Puja 2019

অজানা উত্তরবঙ্গের সন্ধান, যেন হাত বাড়ালেই স্বর্গ

রঙ্গারুন-ছিবো-সিঙ্গেল-লিংসে। এ বার উত্তরবঙ্গের আরও কিছু অচেনা গন্তব্যের সন্ধান।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৯ ১১:৪৭
Share:

লিংসে

রঙ্গারুন চা বাগান

Advertisement

আদর করে অনেকেই একে বলে থাকেন রাইগুরুং। ঘিঞ্জি রাস্তার বাঁকে অলস পাহাড়ি জীবনের ছবি। চলে আসুন জোড়বাংলো যাওয়ার পথে। কাছেই তিন মাইল মোড়। সেখান থেকে ডান দিকে ঢুকে ঘন জনবসতি ছাড়াতেই গহন অরণ্যের মাঝে জনহীন, নির্জন, পাকদণ্ডী চলে গিয়েছে সিঞ্চল স্যাংচুয়ারির অন্দরমহলে। জঙ্গল শেষ হতেই পাহাড়ের গায়ে বাক্সবাড়ি দিয়ে সাজানো রঙিন ফুলের বাহারি পাহাড়িয়া গ্রাম। আর ঠিক তার নীচেই বিস্তীর্ণ ঢালে সবুজ নকশা আঁকা চা-বাগান। উল্টো দিকের নীলচে পাহাড়ের কোলে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর ম্যালের হাতছানি। শুধু কি তাই? জলাপাহাড়, অবজারভেটরি, টাইগার হিল সমেত গোটা দার্জিলিংকে অসাধারণ লাগে। দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৬ কিমি দূরের অনাঘ্রাত সৌন্দর্যের নাম ‘রঙ্গারুন চা বাগান’। একসময় এই বাগানের চা, শোভা পেত বাকিংহ্যাম প্যালেসের অন্দরমহলে। আজ অতটা জৌলুস নেই বটে, রয়ে গিয়েছে বাগানের সুনাম।

এখানে বেশ কিছু বাড়িতে গড়ে উঠেছে হোমস্টে। এদের আন্তরিকতা, অতিথি আপ্যায়ন মুগ্ধ করবে। দুটো দিন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারেন। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে চেনা-অচেনা ফুলের বিছানা আর রাসায়ানিক সারমুক্ত ফসলের বাহার দেখতে দেখতে স্বছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারেন চা-বাগানের অলিগলিতে। হালকা কুয়াশাকে সঙ্গী করে চলে আসুন রুংদুং খোলার ধারে। শীতে, হিমালয়ের হাজারো পরিযায়ীর দেখা মিলবে। এই বাগানের চা এক সময় সুদূর বাকিংহাম প্যালেসের অন্দরমহলে সমাদর পেত। জ্যোৎস্নামাখা রাতের রঙ্গারুন যেন মায়াবী স্বপ্নপুরী। হিরের হার জড়ানো গোটা দার্জিলিংকে আবিষ্কার করুন নতুন ভাবে।

Advertisement

রঙ্গারুন

কী ভাবে যাবেন: নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে ৩ মাইল মোড় থেকে ডান দিকে ৪ কিমি গেলেই রঙ্গারুন চা বাগান। এনজেপি থেকে মোট দূরত্ব ৭৫ কিমি।

কোথায় থাকবেন: এখানে থাকার সেরা ঠিকানা ‘খালিং কটেজ’। যোগাযোগ: +91 9800177852। থাকাখাওয়া সমেত জনপ্রতি ভাড়া ১৫০০ টাকা।

আরও পড়ুন: হিমাচলের জালোরি পাস হয়ে অল্পচেনা রূপকথার সোজা গ্রামে

ছিবো

নীল আকাশের নীচে বাক্সবাড়িতে ঠাসা কালিম্পং। ৪১২৫ ফুট উচ্চতার এক গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি শহর। ডেলো আর দূরপিনদাঁড়ার মাঝে সুন্দর ঝকঝকে শৈলশহর কালিম্পং থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরে ধুপি আর পাইনের পরিপাটি সংসার। এখানেও সারি সারি বাক্সবাড়ি। তবে কিছুটা এগোলেই অপার নির্জনতা ধরা দেবে। ছিবো। এক অল্পচেনা গ্রাম। আকাশ পরিষ্কার থাকলেই কাঞ্চনজঙ্ঘার সদর্প উপস্থিতি, পাখির কলতান, গ্রামের প্রতিটি ঘরবাড়ির কার্নিশে হিমেল হাওয়ায় দোল খাচ্ছে নানা প্রজাতির অর্কিড আর রঙিন ফুলের মেলা। পাহাডের গায়ে জ্যামিতিক খোপের আদলে নকশাদার চাষজমিন। এর বাড়ির উঠোন, ওর বাড়ির বারান্দা পেরিয়ে চলে আসুন এক সুন্দর ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে তিস্তা আর রঙ্গিতের মিলনক্ষেত্রকে পাখির চোখে দেখে নিতে পারেন। আবার গাড়িতে চলে আসতে পারেন দূরপিনদাঁড়া, ডেলো পার্ক, অর্কিড নার্সারি, কালিম্পং মনেস্ট্রি। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা ইচ্ছে হলেই ভেসে পড়তে পারেন প্যারাগ্লাইডিংয়ে। পাখির চোখে গোটা কালিম্পংকে অসাধারণ লাগে। ছোট্ট ছুটিতে ছিবো এক অসাধারণ নিস্বর্গ।

ছিবোর পাহাড়ি সৌন্দর্য

কী ভাবে যাবেন: শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে এনজেপি। সেখান থেকে গাড়িতে কালিম্পং ৭৩ কিমি। ছিবো আরও ৫ কিমি।

কোথায় থাকবেন: এখানে থাকার সেরা ঠিকানা হিমালয়ান ঈগল। ভাড়া ২০০০-৩০০০ টাকা। খাওয়াদাওয়া জনপ্রতি ৭০০ টাকা। যোগাযোগ: ৯৮৩০৬৪৯৩৭৬

সিঙ্গেল চা বাগান

কুয়াশায় মাখা কার্শিয়াং সবসময় জ্যামজমাট। বাজার, পাহাড়ের গায়ে সাঁটা বাক্সবাড়ি, ট্যাক্সিস্টান্ড এলাকা ছাড়িয়ে আরও কিছুটা এগোলেই খাদের ধারের বিশাল পাইনের ছায়ামাখা মিশকালো পথ। সঙ্গী কুয়াশা আর নির্জনতা। আঁকাবাঁকা শিশুরেলের ন্যারোগেজ লাইন। আর তারই ফাঁকে একফালি রাস্তা ঢুকে গিয়েছে সিঙ্গেল চা-বাগানের দিকে। কালিম্পং থেকে প্রায় ৩ কিমি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে মখমলি চায়ের বাগান। ডাইনে উঁচু টিলায় চা বাগান। বামে গোলাকৃতি ঢালে মাথা চাড়া দিয়েছে দু’টি পাতা-একটি কুঁড়ির এক সাজানো সুন্দর ভ্যালি। সিঙ্গেল।

সিঙ্গেল চা বাগান

উতরাই পথ। দু’পাশে জড়িয়ে আছে চা-বাগান। নীচে সিঙ্গেল গ্রামের জনপদ। মাঝে সিঙ্গেল চা ফ্যাক্টরি আর পাশেই বিশাল বাংলো। সেখান থেকে সামান্য দূরে চা-বাগানের ঢালে এক সুন্দর হোমস্টে। এখানে প্রচুর কমলার বাগানও দেখতে পাবেন। এখান থেকে চারপাশের চা-বাগান দেখতে পাওয়া যায়। প্রায় ৫০০০ মিটার উচ্চতায়। এখান থেকে হাল্কা ট্রেক করে অথবা গাড়িতে চলে আসতে পারেন বালাসন নদীর তীরে। দেখে নিতে পারেন ডাওহিল, ফরেস্ট মিউজিয়াম, ডিয়ার পার্ক আর কমলার সিজনে এলে অবশ্যই কফিবেরি কমলা বাগান।

কী ভাবে যাবেন: এনজেপি থেকে রোহিনী হয়ে কার্শিয়াং ৪০ কিমি। এখান থেকে আরও ৩ কিমি গেলেই সিঙ্গেল চা বাগান।

কোথায় থাকবেন: এখানে থাকার জন্য রয়েছে সাঞ্জিমা হোমস্টে। যোগাযোগ: ৯৮৩২৬৬৭৫৭০। ৫টি ঘর। থাকাখাওয়া নিয়ে ১৫০০ টাকা জনপ্রতি। সিঙ্গেল হোমস্টে, ফোন: ৯৮৩২০৫৭৩২৭। দু’জনের থাকাখাওয়া সমেত ২৪০০ টাকা।

আরও পড়ুন: সিকিমের নাথাং ভ্যালির পরনে যেন মেঘের পাগড়ি

লিংসে

কালিম্পং সাব ডিভিশনের এক সুন্দর গ্রাম। ৪৮০০ ফুট উচ্চতায় অল্পচেনা অনাঘ্রাত প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্যে ভরা। মেঘ-পাহাড়, রোদ্দুর-কুয়াশার লুকোচুরি, মিষ্টি গন্ধমাখা পাহাড়ের ধাপে ধাপে বড় এলাচের চাষ, অর্গানিক ফসলের বাহার, দূরে নীলাভ পাহাড়ের স্তর। অচিন পাখিদের কলকাকলিতে ভরপুর এক ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। রাই, সুব্বা ও বিভিন্ন জনজাতির বাস। তাঁদের আন্তরিক আতিথেয়তার উষ্ণতা নিয়েই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া অল্পচেনা পাহাড়-গ্রাম— লিংসে। রংবেরঙের প্রজাপতি, নানান রঙিন ফুল আর অর্কিডের বাহার। পাহাড়ের ধাপে ধাপে সাজানো ঘরবাড়ি। প্রায় ২ কিমি দূরে, পিতমচেন। পাহাড়ের ধাপে নকশাআঁকা চাষজমিতে অর্গানিক ফসলের বাহার। দূরে নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের আসবুজ জঙ্গলমহল। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম। ঘননীল আকাশের মাঝে কাঞ্চনজঙ্ঘার বিস্তার। এই নিয়েই নিরালা-নির্জন পিতমচেনের সংসার। সামনের চড়াই পাথুরে পথ চলে গিয়েছে নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের গভীরে। এ পথ ট্রেকারদের স্বর্গ বললেও ভুল হবে না।

মূলখাড়কা লেক,লিংসে

লিংসে থেকে হেঁটে/ গাড়িতে পিতমচেন হয়ে চলে আসুন মূলখাড়কা লেকে। দূরত্ব ৫ কিমি। পাহাড়চূড়ায় সবুজ ঘাসের গালিচামোড়া ছোট্ট উপত্যকা। হিমেল বাতাসের আবহে দুর্লভ হিম পাখিদের ওড়াউড়ি মন ভরিয়ে দেবে। শ্যাওলা ধরা প্রাচীন পাইনের সারির মাঝে ছোট্ট মন্দির। আকাশের সীমান্তে মাথা উঁচু করে কাঞ্চনজঙ্ঘার রোদস্নানের অপরূপ বাহার। লাল-হলুদ-সবুজ পবিত্র পতাকার বাহার, তারই পদতলে পাইনের ছায়ামাখা এক পবিত্র সরোবর— মূলখাড়কা। ডিম্বাকৃতির সরোবরের চারদিকে সবুজ পাইনের বন, রোদ ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর পবিত্র রংবেরং পতাকার প্রতিচ্ছবি লেকের জলে এসে পড়ে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে দু’চোখ ভরে দেখে নিন কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। পবিত্র লেকের জলে তার প্রতিবিম্ব এসে পড়ে। সমস্ত নীরবতা ভেঙে দিয়ে দমকা হিমেল বাতাস। সঙ্গে ঝিঁঝিঁদের একটানা সিম্ফনি। এক অনবদ্য ছবি আঁকা নিসর্গ।

কী ভাবে যাবেন: এনজেপি থেকে গাড়িতে কালিম্পং প্রায় ৭৩ কিমি। এখান থেকে আলগাড়া-রেশি-রেনক-আরিতার হয়ে লিংসের দূরত্ব প্রায় ৫৭ কিমি। আরিতার থেকে লিংসের দূরত্ব ৪ কিমি। লিংসে থেকে পিতমচেন ২ কিমি। পিতমচেন থেকে মূলখাড়কা ৩ কিমি।

কোথায় থাকবেন: লিংসে-তে থাকার ঠিকানা লিংসে হোমস্টে (৯৪৩৪০-৭২৫৫২), ভাড়া ১৫০০ টাকা। খাওয়া ৬৫০ টাকা মাথাপিছু।

ছবি: লেখক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন