অরণ্যের মাঝে নিভৃতে

রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘন হতে থাকে জঙ্গল। পাকা রাস্তা থেকে মোরাম বিছানো রাঙা মাটির পথ যেখানে শেষ হবে সেখানেই অপেক্ষা করে থাকবে একরাশ ভাল লাগা। মাচান ঘুরে এসে লিখছেন প্রদীপ মুখোপাধ্যায় এমনই একটি জায়গা আউশগ্রামের মাচান। শালপিয়ালের বনের মাঝে একাকিত্বের স্বাদ নেওয়ার জন্য অথবা প্রিয়জনের সঙ্গে অরণ্যের মাঝে দু’-এক দিন কাটিয়ে নিতে ভাল্কীর কাছাকাছি এই মাচানের জুড়ি মেলা ভার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:০৪
Share:

মাচানের অরণ্য।

কোলাহল, ব্যস্ততায় তিতিবিরক্ত হয়ে কিছুটা সময় দূরে, নিভৃতে প্রকৃতির কাছাকাছি কাটাতে কার না ইচ্ছে হয়! এমন জায়গায় যেতে পারলে শরীরের ক্লান্তি জুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। যেতে চান বললেই তো হল না। খরচ আর সময় দু’টির কথাই মাথায় রাখতে হয়। সময় আর পকেটের রেস্ত সমস্যা না হলে, পাহাড়, অরণ্য বা সমুদ্র— যেখানে খুশি যাওয়া যায়। কিন্তু না থাকলে উপায় কী? তা হলে কি প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হতে হবে? না, উদাস হওয়ার কোনও কারণ নেই। নাগালের মধ্যেই এমন বেশ কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে গেলে আর ফিরে আসতে মন চাইবে না।

Advertisement

এমনই একটি জায়গা আউশগ্রামের মাচান। শালপিয়ালের বনের মাঝে একাকিত্বের স্বাদ নেওয়ার জন্য অথবা প্রিয়জনের সঙ্গে অরণ্যের মাঝে দু’-এক দিন কাটিয়ে নিতে ভাল্কীর কাছাকাছি এই মাচানের জুড়ি মেলা ভার। হাতে দিন দুয়েকের সময় নিয়ে এলে প্রকৃতির সান্নিধ্যের পাশাপাশি মাচান থেকেই আশপাশের বেশ কিছু ইতিহাস প্রসিদ্ধ এলাকাও ঘুরে দেখা যেতে পারে।

চলতি অর্থে ‘মাচা’ থেকে ‘মাচান’ কথাটি এসেছে। আউশগ্রামের জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকায় বর্ধমান মহারাজারা বা তারও আগে কোনও রাজা একটি উঁচু মাচার মতো স্থাপত্য তৈরি করিয়েছিলেন। অনেকটা ‘ওয়াচ টাওয়ার’ মতো দেখতে এই স্থাপত্যটি। এর থেকেই এলাকার নাম হয়েছে ‘মাচান’। অনেক ঝড়ঝাপ্টা সামলে এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটি। তবে নগরায়নের থাবা পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে পারেনি আশপাশের শ্যামলিমাকে।

Advertisement

মাচানে যাওয়ার জন্য গুসকরা থেকে সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়াই ভাল। গুসকরা-মানকর রাস্তার মধ্যেই পড়বে এটি। গুসকরা থেকে এগোতে হবে পশ্চিমমুখে। চার-পাঁচ কিলোমিটার যাওয়ার পরেই চোখে পড়বে একটি সুদৃশ্য তোরণ। বাঁ দিকে দিগনগর ২ পঞ্চায়েত কার্যালয়। ডান দিকে, ছোট একটা বসতি। তোরণ দিয়ে ঢুকে গেলেই ডোকরাপাড়া। গায়ে গায়ে লাগানো মাটির বাড়ির উঠোন জুড়ে পরিবারের সকলে মিলে ডোকরার কাজে ব্যস্ত। পর্যটক দেখলেই পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে নিজের কাজ দেখাতে অস্থির হয়ে ওঠেন শিল্পীরা। কী ভাবে ডোকরার কাজ হয়, জানতে চাইলে সাগ্রহে দেখিয়ে দেন এই শিল্পকর্মের প্রতিটি ধাপ। ডোকরাপাড়া থেকে বেড়িয়ে পাকা রাস্তা ধরে আরও কিছু দূর পশ্চিমে এগিয়ে যেতেই রাস্তার বাঁ দিকে কেয়া গাছের জঙ্গল। হয়তো এ জন্যই ওই জায়গাটি ‘কেওতলা’ নামে প্রসিদ্ধ। ভিতরে অন্ত-মধ্যযুগের রেখদেউল আকারের শিবমন্দির। এখানেই সাধক জগদানন্দ ব্রহ্মচারীর আশ্রম রয়েছে। এখান থেকে মোরাম বিছানো পথ দিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেলে বর্ধমান মহারাজাদের তৈরি বেশ কিছু স্থাপত্য নজরে আসবে। এই জনপদের নাম দিগনগর। ইতিহাসের অনেক সাক্ষ্য বহন করে চলেছে গ্রামটি। ১৭৪২ সালে বর্ধমান বিপর্যস্ত হয়েছিল মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের বাহিনীর আক্রমণে। শোনা যায়, ভাস্কর পণ্ডিত এই দিগনগরেই ছাউনি ফেলেছিলেন।

একসময় বর্ধমানের মহারাজ কীর্তিচাঁদ এই জনপদেই চালু করেছিলেন হাট। চাঁদনি রাতে গান শোনার জন্য তৈরি হয়েছিল দিঘি। নাম ‘চাঁদনি’। এই দিঘির চার দিকে বাঁধানো সিঁড়ি রয়েছে। জলাশয়ের মাঝে মুঘল শিল্পরীতির স্থাপত্যটি গ্রামের স্বর্ণোজ্জ্বল অতীতের সাক্ষ্য দেয়। চাঁদনি-কে ডানদিকে রেখে মোরাম বিছানো রাস্তায় কিছুদূর এগিয়ে গেলেই পাবেন জগন্নাথ মন্দির। জনশ্রুতি, পুরীর জগন্নাথ দর্শনের পরে এখানে এসে জগন্নাথ দর্শন করলে তীর্থযাত্রা সফল হয়।

চাঁদনি দিঘি।

দিগনগর থেকে বেড়িয়ে গুসকরা-মানকর পাকা রাস্তা ধরে দু’কিলোমিটার পশ্চিমে এগিয়ে গেলে পড়বে অভিরামপুর বাজার। বাজার পেরিয়েই ডান দিকে ঢুকে গিয়েছে কালো পিচ রাস্তা। সেই আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই দেখা পাওয়া যাবে পর পর জঙ্গলে ঘেরা গ্রাম। রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘন হতে থাকে জঙ্গল। পাকা রাস্তা থেকে মোরাম বিছানো রাঙা মাটির পথ যেখানে শেষ হবে, সেখানেই অপেক্ষা করে থাকবে একরাশ ভাল লাগার মাচানের অরণ্য। এখানে পঞ্চায়েতের তৈরি অতিথিনিবাস রয়েছে। লিজে সেটিকে পরিচালনা করে একটি বেসরকারি সংস্থা।

মাচানে আপনাকে স্বাগত জানাবে নানা প্রজাতির গাছ-গাছালি আর সরল সাদাসিধে আদিবাসীরা। আদিবাসী পুরুষদের মাদলের তাল, রমণীদের নৃত্য আপনার মন ভাল করে দিতে বাধ্য। আউশগ্রামের বিস্তীর্ণ ঘন জঙ্গলে ঘেরা এলাকার সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে যাবে। নাকে ভেসে আসবে মহলদারের তৈরি করা নতুন খেজুর গুড়ের গন্ধ। হয়তো দেখা মিলতে পারে শেয়াল বা খটাস জাতীয় প্রাণীদেরও। তবে দেখা না পেলেও রাতে অবশ্যই তাদের ডাক শুনতে পাবেন।

এর কাছেই অমরারগড়। সেই গ্রামের মধ্যেই শিবাক্ষার প্রাচীন দেউল। এই গ্রামের ইতিহাসও বেশ রোমহর্ষক। ভাল্কীর রাজা ছিলেন ভল্লুপদ। খুবই পরাক্রমী রাজা। জনশ্রুতি, তিনি নাকি ভালুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছিলেন। মানুষের মনে সে বিশ্বাস এখনও জাগ্রত। অনুমান দশম-একাদশ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রাজধানী ছিল এই ভাল্কী। তাঁর পুত্রের নাম গোপাল এবং পৌত্র ছিলেন অমরারগড়ের রাজা মহেন্দ্র। এই রাজার অন্যতম মহিষী ছিলেন অমরাবতী, যাঁর নামে অমরারগড়। সে গড় এখন আর দেখা যায় না, তবে জীর্ণ দেউল, কষ্টিপাথরের মূর্তি এখনও অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই বিগ্রহ না কি রাজা জগৎ সিংহের দেবালয় থেকে লুণ্ঠন করে এনে এখানে প্রতিষ্ঠা করেন রাজা মহেন্দ্র। এখন অমরারগড়ের কুলদেবতা এই দেবী শিবাক্ষা। এই এলাকার আনাচে-কানাচে এ রকম নানা ইতিহাসের সুলুকসন্ধান মিলবে, একটু খোঁজ করলেই।

সেখান থেকে আবার ফিরে আসা মাচানের অতিথি নিবাসে। এখানেই সন্ধ্যায় ব্যবস্থা থাকে আদিবাসী নৃত্যের। কর্তৃপক্ষই সব ব্যবস্থা করে রাখেন। কলকাতা থেকে আর একটি দল বেড়াতে এসেছিল। তাঁদের আবদারে জঙ্গলের ভিতরে ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা হয়েছিল। দূর থেকেই শোনা যাচ্ছিল, শীতের রাতে আগুনের তাপে সেই দলটি গলা ছেড়ে গান ধরেছে। কথায় কথায় জানা গেল, এখানে বেশ কয়েকটি বাংলা চলচ্চিত্র এবং সিরিয়ালের শুট্যিং হয়েছে।

এখানে পর্যটকদের জন্য আলাদা থাকার ঘর যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ডরমিটরিও। আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষও। সামনের জলাশয়ে রয়েছে নৌকাবিহারের ব্যবস্থা। অতিথিনিবাসের দো’তলার ব্যালকনিতে বা তিনতলার ছাদে দাঁড়িয়ে দিগন্ত বিস্তৃত ঘন সবুজ অরণ্যের শোভা দেখতে দেখতে মন ভরে উঠবে। অতিথিনিবাসের সামনে রকমারি ও বাহারি ফুলের বাগান। শিশিরে ভেজা শীতের সকালে মাচানকে ভূ-স্বর্গ ভেবে ভুল করতে পারেন। বাড়তি পাওনা সেই ওয়াচ টাওয়ার বা মাচান এবং তার নীচের সু়ড়ঙ্গটি। জনশ্রুতি, এটিই নাকি বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনীর সু়ড়ঙ্গ।

সামনের দিনগুলি বাঙালির শীতের আনন্দে মেতে ওঠার সময়। চড়ুইভাতি, পিকনিকই বলুন বা নিভৃতে প্রকৃতির মাঝে কয়েকটি দিন কাটানো— সব দিক দিয়েই মাচানের জুড়ি মেলা ভার।

কী ভাবে যাবেন

• লুপ লাইনে গুসকরা স্টেশনে নেমে অভিরামপুর হয়ে মাচান যাওয়া যায়। মেন লাইনে মানকর থেকেও আসা যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল। মন চাইলে সরাসরি গাড়িতেও আসতে পারেন।

• মাচানে মোট সাতটি ঘর এবং একটি ডরমিটরি রয়েছে। ডবল বেড ৭৫০, ট্রিপল বেড ৯০০, চারটে বেড ১২০০ এবং পাঁচটি বেডযুক্ত রুমের ভাড়া ১৩০০ টাকা। ডরমিটরির ভাড়া ২৫০০ টাকা। এসি হলে প্রতিটি রুমে ৩০০ টাকা করে বাড়তি লাগবে। পুকুরের টাটকা মাছ, মাংস এবং পছন্দ মতো খাবার পাওয়া যায়। চার জনের একটি দলের এক দিনের খরচ মোটামুটি ১৮০০ টাকা।

কী দেখবেন

• মাচানের অরণ্য তো আছেই। পাশাপাশি আসার পথে দেখে নিন ডোকরাপাড়া, চাঁদনি দিঘি। মাচান থেকে চলে যেতে পারেন অমরারগড়ে। এ ছাড়া আশপাশে বেশ কয়েকটি প্রাচীন মন্দির ও স্থাপত্য দেখতে পারেন।

ছবি:লেখক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন