নরেশের দেহ নিতে মুখোমুখি শ্বশুর ও বোন

বুধবার সকালে মুখোমুখি বসে চা খেলেন তাঁরা। মর্গে গেলেন এক গাড়িতে চড়ে। সেখানকার ঠান্ডা ঘরে শুয়ে আছে অভিযুক্ত নিভা সাহার যমজ ভাই নরেশ পানের দেহ।

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:২২
Share:

জগদ্দল থানা থেকে বেরোনোর পরে নিমাইবাবু। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।

এক জন অভিযোগকারী। অন্য জন অভিযুক্ত।

Advertisement

বুধবার সকালে মুখোমুখি বসে চা খেলেন তাঁরা। মর্গে গেলেন এক গাড়িতে চড়ে। সেখানকার ঠান্ডা ঘরে শুয়ে আছে অভিযুক্ত নিভা সাহার যমজ ভাই নরেশ পানের দেহ। অভিযোগকারী নিমাই ঘোষ নরেশের শ্বশুর।

জগদ্দলের কুতুবপুরের বাসিন্দা, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ান নরেশের শেষকৃত্য অবশ্য বুধবার হয়নি। স্থানীয় পুরসভা এবং থানা ঘুরে কলকাতার কম্যান্ড হাসপাতালে এসে পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। ঠিক হয়েছে, বৃহস্পতিবার সেই দেহের ময়না-তদন্তের পরে তাঁর শেষকৃত্য করা হবে। মুখাগ্নি করবে নরেশের আট বছরের ছেলে সন্দীপ।

Advertisement

পুলিশ জানিয়েছে, নরেশের স্ত্রী, নিমাইবাবুর বড় মেয়ে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে বনিবনা ছিল না নরেশের মা আরতি পানের। অভিযোগ উঠেছিল ননদ নিভার বিরুদ্ধেও। গত সপ্তাহের মঙ্গলবার বাড়িতে অশান্তির জেরে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেন প্রিয়াঙ্কা। বড় ছেলে সন্দীপ ও ছোট ছেলে, সাড়ে তিন বছরের সায়ন তখন স্কুলে। স্ত্রীকে বাঁচাতে ছুটে গিয়েছিলেন নরেশ। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে আগুনে গুরুতর ভাবে জখম হয়েছিলেন তিনিও। দু’জনকেই কলকাতার কম্যান্ড হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়।

গত শনিবার সেই হাসপাতালেই মারা যান প্রিয়াঙ্কা। খবর পাওয়ার পরে মেয়ের মৃত্যুর শোক সামলাতে না পেরে সে দিনই কীটনাশক খেয়ে ফেলেন নিমাইবাবুর স্ত্রী শিখাদেবী। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মৃত্যু হয় তাঁর। রবিবার ব্যারাকপুরে মা ও মেয়ে, দু’জনেরই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। শনিবার রাতেই নরেশের মা আরতিদেবী ও বোন নিভার বিরুদ্ধে জগদ্দল থানায় মেয়েকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করেন নিমাইবাবু। সেই রাতেই গ্রেফতার করা হয় আরতিদেবীকে। নিভা বিবাহসূত্রে কৃষ্ণনগরে থাকেন।

মঙ্গলবার সকালে নরেশের মৃত্যুর পরে তাঁর মৃতদেহ কে নেবেন, তা নিয়ে শুরু হয় টানাপড়েন। আরতিদেবী এখন দমদম জেলে বন্দি। তাঁকে প্যারোলে ছাড়ানোর আবেদন করতে রাজি হননি নরেশের কাকাদের কেউই। জামাইয়ের দেহ নিয়ে সৎকার করতে এগিয়ে আসেন শ্বশুর নিমাইবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘মেয়ে, স্ত্রী, জামাই— আমার তো সবাই চলে গেল। ছোট দুটো বাচ্চাকে নিয়ে আমি একা বুড়ো মানুষ কী করব, বলতে পারেন? জামাইয়ের বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ ছিল না। আর জামাইয়ের ছেলে, আমার আট বছরের নাতি সন্দীপ মায়ের মুখাগ্নি করেছে। সন্দীপ আমার কাছেই রয়েছে। ও-ই বাবার মুখাগ্নি করবে।’’

মঙ্গলবার পুলিশ নিভাদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরে বুধবার সকালে কৃষ্ণনগর থেকে তিনি পৌঁছে যান জগদ্দল থানায়। যমজ ভাই নরেশের দেহ নিতে চান তিনি। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন নিমাইবাবুও। এই নিভার নামেই থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি। নিজের বোন বলে পুলিশ নরেশের দেহ নেওয়ার অনুমতি দেয় নিভাকেই।

তবে, এখন নরেশের দেহ নেওয়ার অধিকার তাঁর বোনের হাতে তুলে দিলে পরবর্তীকালে নরেশ-প্রিয়াঙ্কার সম্পত্তির অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের দুই সন্তানের কোনও রকম সমস্যা হতে পারে কি না, তা নিয়েও এ দিন প্রশ্ন ওঠে। তবে পুলিশ আশ্বস্ত করে জানিয়ে দেয়, সম্পত্তির অধিকার একমাত্র সন্তানদেরই থাকবে।

গত কয়েক দিন ধরে নিমাইবাবুর উপরে যে ঝড় বয়ে গিয়েছে, তা অনুধাবন করে নিভাই এগিয়ে আসেন তাঁর কাছে। নিভাদেবীকে সামনে পেয়ে শোকার্ত বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘তোমারই তো বৌদি। তার মা-ও তো তোমার মায়ের মতোই। এক বার খোঁজটুকু নিলে না। আর আজ দাদার দেহ নিতে ছুটে এলে!’’

নিভাদেবীরও তখন চোখে জল। মাথা নিচু করে বৃদ্ধের কাছে এসে বললেন, ‘‘আমি পারিনি। আইন অনুযায়ী যা হচ্ছে, হোক। আপনি যা বলবেন, তা-ই হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন