এই ঘর থেকেই এ বার চলবে কাজ।
ভরসা হারিয়েছিল বছর কয়েক আগে। তবু ভেঙে পড়েননি গ্রামবাসী।
ভাঙাচোরা ডাকঘর আর তার পরিষেবা নিয়ে ল্যাজেগোবরে হচ্ছিলেন মানুষ। বাধ্য হয়ে নিজেরাই চাঁদা তুলে ডাকঘরের ভবন তৈরি করে দিলেন তাঁরা।
ঘটনাটি দেগঙ্গার হাদিপুর কালীতলার। এলাকার শতাব্দী প্রাচীন একমাত্র ডাকঘরটি ভেঙে পড়েছিল। বন্ধ হতে বসেছিল পরিষেবা। কাজ চালু রাখতে গ্রামেরই এক বাসিন্দার বাড়ি থেকে ডাকঘরের কাজ চালানো হয়েছে কিছু দিন।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন-নিবেদন করেও নতুন ভবন মেলেনি বলে অভিযোগ। একটা সময়ে গ্রামের মানুষ বাধ্য হয়ে নিজেরাই ঠিক করেন, চাঁদা তোলা শুরু করেন। প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা জোগাড় হয়। তৈরি হয় ডাকবিভাগের নতুন ভবন। সোমবার সকালে ফিতে কেটে সেই নতুন ভবনটি তুলে দেওয়া হয় ডাকবিভাগের হাতে। উপস্থিত ছিলেন দেগঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক লিটন রক্ষিত, দেবালয় ডাকবিভাগের ভারপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার উত্তম পোদ্দার। ছিলেন উৎসাহী গ্রামবাসীরাও।
বারাসতে জেলার মুখ্য ডাকঘরের আধিকারিক সুধাংশু বিশ্বাস জানান, দেগঙ্গার ডাকঘরের বিষয়টি তাঁদের জানা ছিল। এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাও হয়েছিল। কিন্তু এ বাদে তাঁদের ভবন তৈরি নিয়ে আর কিছু করার ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে গ্রামবাসীরাই এগিয়ে এসেছেন।
প্রায় একশো বছর আগের কথা। হাদিপুর গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দানের জমিতে গড়ে ওঠে ডাকঘরটি। প্রথমে ছিল মাটির দেওয়াল, টিনের ছাউনি। ১৯৮৭ সালের দিকে সংস্কারের অভাবে ক্রমশ ভবনটি জীর্ণ হতে থাকে।
এক দিকে নতুন ডাকঘর ভবন তৈরি হচ্ছিল না। কিন্তু ডাক পরিষেবা গ্রামের মানুষের কাছে খুবই প্রয়োজনীয়। সে দিক থেকে বিচার করে গ্রামের বাসিন্দা প্রভাত দে-র বাড়ি থেকে শুরু হয় ডাকঘরের কাজকর্ম। ঘরের সংস্কার করে ডাকঘর চালু রাখতে কলকাতার ডাকবিভাগের কাছে আবেদন জানান গ্রামের মানুষ। তিন বছর পরে ডাকবিভাগ থেকে সেখানে শুধুমাত্র কাঁটাতারের বেড়ার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু ভেঙে পড়া ভবনটির সংস্কারের হয় না।
প্রভাতবাবু বলেন, ‘‘গ্রামের আদি ডাকঘরটিকে বাঁচাতে আমরা বারাসাত জেলা ডাকবিভাগেও অনেকবার গিয়েছি। গ্রামের মানুষের পক্ষ থেকে কতবার লিখিত আবেদনও জানানো হয়। তারপরেও কেটে গিয়েছে কয়েক বছর। কিন্তু লাভ হয়নি।’’ গ্রামবাসীরা জানালেন, পরে প্রভাতবাবুর বাড়ি থেকে ডাকঘরটি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হাদিপুর গ্রামের ভারপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার মহম্মদ নাসিরউদ্দিনের বাড়িতে। এলাকাবাসীর দাবি, সেখান থেকেও পরিষেবা পেতে নানা অসুবিধা হচ্ছিল। এরপরে গ্রামের ডাকঘর এলাকাতেই থাকুক, এমন দাবিতে নিজেরাই ডাকঘর তৈরির সংকল্প করেন স্থানীয় মানুষজন। চলতি বছরের ৩ মার্চ গ্রামের তেরোজনকে নিয়ে গড়া হয় “নির্মাণ কমিটি’।
নিজেদের দেওয়া টাকা তো ছিলই, তা ছাড়াও, রাস্তায় দাঁড়িয়ে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে ওই কমিটির পক্ষ থেকে তোলা হয় সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা। নিজেরাই তদারকি করে কিছু শ্রমিক নিয়ে প্রায় মাস আটেকের চেষ্টায় আস্তে আস্তে মাথা তুলে দাঁড়ায় নতুন ভবনটি। গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হামিদ মণ্ডল, গোলাম মোস্তাফা, মানিক লালদের মতো অনেকে ছিলেন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। তাঁদের কথায়, ‘‘সরকারি সাহায্য মেলেনি। তবুও আমরা তৈরি করতে পেরেছি আমাদের পুরনো ডাকঘর। খুবই ভাল লাগছে।’’
ভাঙাচোরা পুরনো দশা।
স্থানীয় চিকিৎসক তথা নির্মাণ কমিটির সভাপতি সুকৃতি রায় বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন আমরা সরকারি দফতরে অনুনয়-বিনয় করেছি। কেউ পাত্তা দেয়নি। বাধ্য হয়ে নিজেরাই ভবন তৈরির সিদ্ধান্ত নিই। কাজ শেষে, সোমবার তা তুলে দেওয়া হল ডাকবিভাগের হাতে।’’
সোমবার গিয়ে দেখা গেল, ঝাঁ চকচকে ভবনটির মধ্যে ডাকবিভাগে কর্মীরা কাজে ব্যস্ত। ডাকবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার মহম্মদ নাসিরুদ্দিন বলেন, ‘‘সরকার যা পারল না, গ্রামের মানুষ তা করে দেখালেন।’’ দেগঙ্গার হাদিপুর ঝিকরা ১ পঞ্চায়েত থেকেও দেওয়া হয়েছে ২ লক্ষ টাকা। তা দিয়ে ডাকঘরের ভিতরে একটি নলকূপ ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
এ দিন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে দেবালয়ের ডাকমাস্টার উত্তম পোদ্দার বলেন, ‘‘এ হল মানুষের জয়।’’
ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়।