হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মালতি সর্দার। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।
বাংলা মদের আসর থেকে ফিরে একে একে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন কয়েক জন গ্রামবাসী। রক্তবমি হতে থাকে সকলের। এক জন মারা যান শুক্রবার রাতে। কোনও চিকিৎসার সুযোগই মেলেনি। বাকি পাঁচ জনকে পর দিন এমআর বাঙ্গুর হাসপাতালে আনা হলেও বাঁচানো যায়নি। বিভিন্ন হাসপাতালে এখনও চিকিৎসাধীন জনা সাতেক।
ঘটনাস্থল দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলির চুপড়িধরা পঞ্চায়েতের পূর্ব রাধাবল্লভপুর। ঘটনাচক্রে এই জেলারই আর এক প্রান্ত মগরাহাটের সংগ্রামপুরে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে চোলাই মদের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছিল ১৯৩ জনের।
এ বার অবশ্য বাংলা মদে বিষক্রিয়াই মৃত্যুর কারণ বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে পুলিশ। মৃতদেহগুলি ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে।
চোলাই মদে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনা রাজ্যের নানা প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে ঘটে থাকে। নেশার ‘তেজ’ বাড়াতে চোলাইয়ের মধ্যে নানা রাসায়নিক মেশানোই যার কারণ বলে আবগারি দফতর সূত্রের খবর। চোলাই মদের ব্যবসা পুরোটাই বেআইনি। কিন্তু, বাংলা মদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লাইসেন্সের ব্যবস্থা আছে। আবগারি দফতরের নজরদারিও করার কথা। রীতিমতো রাজস্ব দিয়ে এই ব্যবসা চালাতে হয়। ফলে বাংলা মদের বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনা এ রাজ্যে তেমন নজরে পড়ে না।
তা হলে কুলতলির ঘটনা ঘটল কী ভাবে?
স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, মগরাহাট কাণ্ডের পরে গোটা জেলায় চোলাই মদের ব্যবসার উপরে নজরদারি অনেকটাই বাড়িয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। ফলে সেই ব্যবসায় এখন অনেকটাই ভাটা। তুলনায় বেড়েছে সস্তার বাংলা মদের কারবার। বিভিন্ন বাজার থেকে বাংলার মদের বোতল কিনে প্রত্যন্ত এলাকার গাঁয়ে-গঞ্জে নিয়ে চলে যায় কারবারিরা। কোথাও মুদির দোকান থেকে, কোথাও পানের দোকান থেকে বিক্রি হয় বাংলার মদের বোতল। প্রশাসন ও পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, চোলাইয়ের রমরমা কারবার কমতে থাকায় ইদানীং বাংলা মদের ব্যবসায় নজরদারি কিছুটা শিথিল করা হয়েছিল। যে কারণে বাংলা মদের বিক্রির জন্য রেজিস্ট্রার করা দোকান ছাড়াও অন্য নানা দোকান থেকে বোতল বিক্রি হচ্ছে খানিকটা অবাধেই।
আর সমস্যাটা সেখানেই। বাংলার মদের বোতল কিনে তাতে কিছু মিশিয়ে পরিমাণে বাড়িয়ে বাড়তি দু’পয়সা লাভ করতে চাইছে অনেকে। কী মেশানো হচ্ছে, কতটা মেশানো হচ্ছে, সে সবের উপরে কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকার ফলেই বাংলা মদে বিষক্রিয়ার ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করেন পুলিশ-প্রশাসনের ওই অংশটি।
কুলতলির ঘটনাতেও জানা গিয়েছে, জামতলা হাট থেকে বাংলা মদ কিনে এনে উত্তর রাধাবল্লভপুরে নিজের বাড়িতেই ঠেক খুলে বসেছিলেন মালতি সর্দার নামে এক মহিলা। শুক্রবার সেখানেই মদ্যপান করতে এসেছিলেন মাধবী পাহান (২৭), শরদ সর্দার (৪২), নেপাল সর্দার (৫৬), লক্ষ্মী মুণ্ডা (৩০), লক্ষ্মীন্দর মুণ্ডা (৩৫), খোদাবক্স লস্কর (৪৫)। রাত থেকেই একে একে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন সকলে। শরদের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, রাতেই ভেদবমি করতে করতে মারা যান ওই ব্যক্তি। সকালে তাঁকে বাড়ির জমিতেই কবর দেওয়া হয়। শনিবার বাকিদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এমআর বাঙ্গুর হাসপাতালে। পথেই মারা যান খোদাবক্স। বাকিদের হাসপাতালে আনার পরে মৃত্যু হয়। চিকিৎসার পরিভাষায় প্রত্যেকেরই হৃদ্যন্ত্র বিকল হয়ে (কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট) মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর। এখনও চিকিৎসাধীন মৃণাল সর্দার, সূর্য পৈলান, লক্ষ্মীরাম সর্দার, তপন সর্দার, গৌর সর্দার, শম্ভু সর্দাররা। আরও পাঁচ জনকে জামতলা হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মালতি নিজেও ওই দিন মদ্যপান করেছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় এখন ভর্তি জামতলা হাসপাতালে। কোনও মতে জানালেন, হাট থেকে অন্য দিনের মতোই বাংলা মদ এনে বাড়িতে বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু, তা খেয়ে এমন দুর্ঘটনা ঘটবে, ভাবতে পারেননি।
রবিবার আদিবাসী অধ্যুষিত ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, যে মদ খেয়েছিলেন সকলে, সে সব কিছু বোতল এখনও গড়াগড়ি খাচ্ছে মালতির বাড়িতে। গায়ে লেখা ‘উড়ান’। কিন্তু, কোনও ব্যাচ নম্বর নেই। একটি ঠিকানা আছে। সেখানে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
কুলতলির প্রাক্তন বিধায়ক এসইউসি-র জয়কৃষ্ণ হালদার, বর্তমান বিধায়ক সিপিএমের রামশঙ্কর হালদাররা ইতিমধ্যেই অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন, পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারির অভাবেই বাংলা মদে বিষক্রিয়ার ঘটনা এত জনের মৃত্যু ঘটল। আবগারি দফতরেরও উদাসীনতা এ জন্য দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন তাঁরা।