ফাইল চিত্র
একের পর এক দুর্ঘটনা। গত কয়েক মাসে বঙ্গোপসাগরে তিন তিনবার ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ৪০। এ বার অবশ্য নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। সতর্কতামূলক নানা পদক্ষেপ করা হচ্ছে।
কিন্তু কেন বার বার দুর্ঘটনা?
কাকদ্বীপ, নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জ— মূলত এই তিন বন্দর থেকেই সব থেকে বেশি ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। মৎস্য দফতরের সামুদ্রিক বিভাগের ডায়মন্ড হারবারের সহকারী অধিকর্তা সুরজিৎ বাগ জানালেন, সমুদ্রের গভীরে যাওয়ার জন্য দ্বীপ-ঘেরা যে সমুদ্রপথ মৎস্যজীবীরা ব্যবহার করেন, সেগুলি মূলত খাড়িপথ। এগুলি এমনিতেই অগভীর। তার উপরে পলি জমে সেই পথের নাব্যতা প্রতিনিয়ত কমছে। খারাপ আবহাওয়ায় ট্রলারগুলি এই পথেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে।
সুন্দরবন সামুদ্রিক মৎস্যজীবী শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক সতীনাথ পাত্র এবং পশ্চিমবঙ্গ সংগঠিত মৎস্যজীবী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বিজন মাইতিও জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরে সব ক’টি ট্রলার দুর্ঘটনা ঘটেছে বন্দর থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটারের মধ্যে। মূলত জম্বু দ্বীপ, কেঁদো দ্বীপ, লুথিয়ান দ্বীপ-সহ আশেপাশের দ্বীপ এলাকার কাছে ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটছে।
সতীনাথবাবু জানচ্ছেন, খারাপ আবহাওয়ার সতর্ক বার্তা পেয়ে কোনও ট্রলার হয় তো পাড়ে ফিরছে। দ্বীপগুলোর কাছাকাছি এসে নাব্যতার অভাবে ফিরতে বাধা পাচ্ছে। সেই সময়ে ঝড় এবং ঢেউয়ে ট্রলার উল্টে যাচ্ছে।
সুরজিৎ বলেন, ‘‘বিষয়টি অনেক দিন ধরেই আমরা লক্ষ করেছি।’’ একটি নতুন ভাবনার কথাও জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা ভাবছি, সমুদ্রে যাওয়ার এতগুলি রুট না করে নির্দিষ্ট একটা চ্যানেল যদি করা যায়। আর সেই চ্যানেলের নাব্যতা যদি ঠিক রাখা যায়, তা হলে দুর্ঘটনার সংখ্যা হয় তো কমানো যাবে।’’ একই সঙ্গে চ্যানেলের বিপজ্জনক এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে বয়া বসানোর ভাবনাচিন্তার কথাও জানাচ্ছেন তিনি।
বিজন জানালেন, কাকদ্বীপ এবং স্থানীয় মৎস্য বন্দরগুলিতে ট্রলারের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজার। ‘নন মেকানাইজড বোট’ অর্থাৎ ভুটভুটি রয়েছে আরও চার হাজার। মৎস্যজীবীর সংখ্যা দেড় লক্ষেরও বেশি। কাকদ্বীপের স্থানীয় অর্থনীতি পুরোটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে মাছের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। পরোক্ষে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আরও কয়েক লক্ষ মানুষ।
মৎস্যজীবীদের সুরক্ষায় যে গাফিলতি রয়েছে তা মানছেন সতীনাথরা। লাইফ জ্যাকেট তো বটেই, সুরজিৎ জানালেন, ট্রলারে লাইফ বয়া রাখাও বাধ্যতামূলক। কিন্তু কার্যত কোনও ট্রলারেই তা নেই। লাইফ জ্যাকেট না থাকলে ট্রলারের রেজিস্ট্রেশন হওয়ার কথা নয়। মালিকেরা বলছেন, লাইফ জ্যাকেট শ্রমিকেরা পরতে চান না। সুরজিৎ বলেন, ‘‘এ কোনও যুক্তি হতে পারে না। শ্রমিকদের লাইফ জ্যাকেট পরানোর দায়িত্ব মালিকদেরই।’’
সম্প্রতি প্রশাসনিক স্তরে মৎস্যজীবীদের নিয়ে যে বৈঠক হয়েছে, তাতে নজরদারি আরও জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। ট্রলার মালিক, শ্রমিক ইউনিয়ন, মৎস্য দফতরের কী ভাবনা তা অবশ্য জানেন না পায়েল হালদার, বিট্টু দাস, সুজাতা ভদ্ররা। তাঁরা জানেন, তাঁদের বাড়ির লোক আর কখনও নিকোনো উঠোনে এসে দাঁড়াবেন না। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে রবিন ভদ্র মারা গিয়েছেন ট্রলার ডুবিতে। তাঁর স্ত্রী সুজাতার কথায়, ‘‘বালবাচ্চা নিয়ে আমরা কী ভাবে বেঁচে আছি, তা তো আর কেউ দেখতে আসবে না।’’ পড়ন্ত বিকেলে উদাস শোনায় সদ্য স্বামীহারা স্ত্রীর গলা। চার মাস আগে রণজিৎ হালদারকে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে এসেছিলেন বছর আঠারোর পায়েল। রণজিতের দেহ উদ্ধার হয়েছে সমুদ্র থেকে। এখনও যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না ঘটনা।
সদ্য তরুণীর প্রশ্ন, ‘‘ও আর সত্যিই ফিরবে না?’’
(চলবে)