দেড়শো বছরে পা জয়নগর পুরসভার

১৮৬৩ সাল নাগাদ শিক্ষা-সংস্কৃতি সাহিত্য চর্চার নিরিখে দু’টি বর্ধিষ্ণু গ্রাম— জয়নগর ও মজিলপুরকে শহরে পরিণত করতে উদ্যোগ করেন স্থানীয় কিছু ব্যক্তি।

Advertisement

সমীরণ দাস

জয়নগর শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৫৮
Share:

উদযাপন: পায়রা উড়ানো হল জয়নগর পুরসভায়। ছবি: সুমন সাহা।

দেড়শো বছরে পড়ল জয়নগর-মজিলপুর পুরসভা। জেলার তো বটেই, এটি রাজ্যের প্রাচীনতম পুরসভাগুলির একটি।

Advertisement

জয়নগর জনপদটির উৎপত্তি প্রায় চারশো বছর আগে। একটা সময়ে এই এলাকা ঘনজঙ্গলে ঢাকা ছিল। মাঝখান থেকে বয়ে যেত আদিগঙ্গা। সেই জঙ্গল কেটেই পরবর্তীকালে তৈরি হয় জনপদ। শোনা যায়, জমিদার গুণানন্দ মতিলাল এখানে প্রথম বসবাস শুরু করেন। তবে অনেকে বলেন, গুণানন্দের আগেও জয়নগরে মতিলালদের জমিদারি ছিল। পরবর্তী কালে প্রথমে মিত্র এবং পরে দত্ত বংশের লোকজন এখানে এসে জমিদারি পত্তন করেন। সে সময় থেকেই শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বেশ বর্ধিষ্ণু এই এলাকা। শোনা যায়, শাস্ত্র-সংস্কৃতি চর্চায় সে সময়ে নবদ্বীপের সঙ্গে তুলনা টানা হত জয়নগরের।

১৮৬৩ সাল নাগাদ শিক্ষা-সংস্কৃতি সাহিত্য চর্চার নিরিখে দু’টি বর্ধিষ্ণু গ্রাম— জয়নগর ও মজিলপুরকে শহরে পরিণত করতে উদ্যোগ করেন স্থানীয় কিছু ব্যক্তি। গঠিত হয় ‘টাউন কমিটি।’ এর বছর ছ’য়েক পরে ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার বঙ্গীয় পৌর আইন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই অনুমোদন পায় জয়নগর-মজিলপুর পুরসভা। টাউন কমিটির সভাপতি হরানন্দ বিদ্যাসাগর পুরসভার চেয়ারম্যান পদে বসেন। টাউন কমিটির অন্য সদস্যেরা হন কমিশনার। সেই শুরু হয় পুরসভার যাত্রা।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

হরানন্দ বিদ্যাসাগর ছিলেন সে সময়ের অন্যতম শিক্ষাব্রতী। শোনা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। শিক্ষায় কৃতিত্বের জন্য তাঁকেও ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দেওয়া হয়। জয়নগরে সে সময়ে জমিদারি ছিল মিত্র ও দত্তদের। তবে পুরসভা গঠনের পরে চেয়ারম্যান পদে জমিদার বংশের কেউ না বসে বসানো হয় হরানন্দকেই। পুরসভার বর্তমান এক কাউন্সিলরের কথায়, ‘‘জয়নগর যে বরাবর শিক্ষাকে আলাদা সম্মান জানিয়ে এসেছে, এই ঘটনাই তার প্রমাণ।’’

সে সময়ে অবশ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল না। পুরনো নথি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, পুরসভার প্রথম নির্বাচন হয় ১৮৭৭ সালের পরে। হরিদাস দত্ত পুরসভার প্রথম নির্বাচিত পুরপ্রধান হন। ইতিহাস বলছে, প্রাথমিক ভাবে গোটা এলাকাকে চারটি ওয়ার্ডে ভাগ করে পুরসভার কাজকর্ম শুরু হয়েছিল। তবে সে সময়ে একেকটি ওয়ার্ড থেকে একাধিক প্রতিনিধি নির্বাচনের চল ছিল। অনেক পরে, ১৯৬২ সালে পুরসভার কাজের সুবিধার জন্য ওই একই পুর এলাকাকে ১১টি ওয়ার্ডে ভাঙা হয়। আরও পরে ১৯৯৫ সালে ১১টি আসন ভেঙে করা হয় ১৪টি। এখনও পুরসভার আসন সংখ্যা সেই ১৪-ই।

ইতিহাস বলছে, টাউন কমিটি তৈরি হওয়ার পর থেকেই এলাকার উন্নতিতে নানা উদ্যোগ করা শুরু হয়েছিল। পুরসভা গঠন হওয়ার পরে কয়েক বছরে পুরপ্রধান ও কমিশনারদের উদ্যোগে এলাকার রাস্তাঘাট, পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থার প্রচুর কাজ হয়। হরিদাস দত্ত পুরপ্রধান হওয়ার পরে এলাকার বহু মাটির রাস্তায় ইটের খোয়া ও সুড়কি ফেলা হয়। ১৮৮৬ সালে পুর এলাকায় প্রথম রাস্তার আলোর ব্যবস্থা হয়েছিল। তখন অবশ্য বৈদ্যুতিক বাতি ছিল না। তৎকালীন পুরপ্রধান আনন্দচন্দ্র ঘোষ বেশ কয়েকটি জায়গায় লোহার খুঁটির মাথায় কেরোসিনের বাতির ব্যবস্থা করেন। ১৯০৪ সালে পুরসভার উদ্যোগে তৈরি হয় একটি দাতব্য চিকিৎসালয়। ১৯৫০ সাল নাগাদ তৎকালীন চেয়ারম্যান সুধীরকৃষ্ণ দত্তের উদ্যোগে তৈরি হয় প্রসূতিদের জন্য আলাদা চিকিৎসাকেন্দ্র ‘মাতৃমঙ্গল-শিশুমঙ্গল।’ ১৯৬৯ সালে মনোরঞ্জন দত্ত চেয়ারম্যান থাকাকালীন পুর এলাকার রাস্তায় প্রথম বৈদ্যুতিক আলো বসে। তাঁর আমলেই পুরসভার আলাদা খেলার মাঠ তৈরি হয়। এখনকার জয়নগর টাউন হল তৈরির প্রাথমিক উদ্যোগও করেছিলেন তিনি।

১৯৮১ সালে পুরসভার চেয়ারম্যান হন প্রশান্ত সরখেল। টানা প্রায় তিরিশ বছর দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তাঁর সময়েই খোলনলচে বদলে যায় পুরসভার। পুরভবনেরও আমূল সংস্কার হয়। সরকারি অনুদান, নাগরিক করের বাইরে পুরসভার আলাদা আয়ের ব্যবস্থা করেন তিনি। তাঁর উদ্যোগে পুরসভার জায়গায় একাধিক ব্যাঙ্কের শাখা তৈরি হয়। পুরভবনের কাছেই তৈরি হয় কমিউনিটি সেন্টার। পুরসভার নিজস্ব এম্বুলেন্স পরিষেবাও চালু করেন তিনি।

রাজ্যে বামজমানার দীর্ঘ ইতিহাসের মাঝেও এই পুরসভা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চরিত্র বজায় রেখেছিল। প্রশান্ত সরখেলের হাত ধরে এখানে টানা প্রায় ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস।

তবে স্থানীয়দের অনেকেই জানাচ্ছেন, রাজনৈতিক পরিচয়ের থেকেও ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় প্রশান্তবাবু ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। ২০১০ সালে তৃণমূল-এসইউসি জোট পুরসভা দখল করে। পুরপ্রধান হন ফরিদা বেগম শেখ। তিনিই পুরসভার প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র মহিলা পুরপ্রধান। ২০১৪ সালে এখানে ক্ষমতা পুনর্দখল করে কংগ্রেস। সুজিত সরখেল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

সোমবার তাঁর নেতৃত্বেই পালিত হল সার্ধশতবর্ষপূর্তির বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। পুরপ্রধানের কথায়, ‘‘আমাদের ছোট্ট শহর। মানুষে মানুষে আন্তরিকতাটাই আমাদের সম্পদ। এই আন্তরিকতাটা এ রকম আরও বহু বছর টিকে থাকে, এটাই চাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন