পাওনা মেটাতে পাঁচ বছর নেবে মিল

অবসরের পরে দশক পেরলেও রাজ্যে চটকল শ্রমিকদের অধিকাংশের প্রাপ্য গ্র্যাচুইটির শিকে ছেঁড়েনি, এ অভিযোগ নতুন নয়। অধরা গ্র্যাচুইটির প্রশ্নে এ বার শ্রমিকদের ‘পোস্ট ডেটেড চেক’ দিয়ে দায় এড়ানোর অভিযোগ উঠল চটকল কতৃর্পক্ষের বিরুদ্ধে। ২০১০ সালে, উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়া এলাকার মেঘনা জুটমিল থেকে অবসর নেওয়ার পরে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও, মিল কর্তৃপক্ষ থেকে জেলা শ্রম দফতরের দরজায় ঘুরেও নিজের গ্র্যাচুইটির টাকা হাতে পাননি ধীরেন দাস।

Advertisement

রাহুল রায়

ভাটপাড়া শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৫ ০১:১২
Share:

অবসরের পরে দশক পেরলেও রাজ্যে চটকল শ্রমিকদের অধিকাংশের প্রাপ্য গ্র্যাচুইটির শিকে ছেঁড়েনি, এ অভিযোগ নতুন নয়। অধরা গ্র্যাচুইটির প্রশ্নে এ বার শ্রমিকদের ‘পোস্ট ডেটেড চেক’ দিয়ে দায় এড়ানোর অভিযোগ উঠল চটকল কতৃর্পক্ষের বিরুদ্ধে।

Advertisement

২০১০ সালে, উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়া এলাকার মেঘনা জুটমিল থেকে অবসর নেওয়ার পরে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও, মিল কর্তৃপক্ষ থেকে জেলা শ্রম দফতরের দরজায় ঘুরেও নিজের গ্র্যাচুইটির টাকা হাতে পাননি ধীরেন দাস। এ বছরের গোড়ায় কিস্তিতে তাঁকে গ্র্যাচুইটির প্রাপ্য টাকা দেওয়া হবে বলে জানান মিল কর্তৃপক্ষ। তা পাঁচটি কিস্তিতে, পোস্ট ডেটেড চেক-এর মাধ্যমে। চেক-এর তারিখ—২০১৫ সালের নভম্বর মাস থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি। এ অবস্থায় শ্রমিক আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন দীর্ঘ দিন ধরে হৃদরোগের সমস্যায় জর্জরিত ওই চটকল শ্রমিক।

নিজেদের প্রাপ্য গ্র্যাচুইটির দাবিতে শ্রমিক আদালত থেকে উচ্চ আদালতে পা বাড়িয়েছেন, রাজ্যে এমন চটকল শ্রমিকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। শ্রম দফতরের সমীক্ষা বলছে, অর্থাভাবে অনেকেই সে মামলা চালানোর খরচ জোগাড় করতে না পেরে হাত তুলে দিয়েছেন। অধরা গ্র্যাচুইটির স্বপ্ন নিয়ে নিশ্চুপে মারাও গিয়েছেন অনেকে।

Advertisement

ওই দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, অবসরের পরে শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি এক বারেই দেওয়ার কথা। শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন, ‘‘কিস্তিতে গ্র্যাচুইটি মেটানোর নিয়ম শ্রম আইনে নেই। গ্র্যাচুইটির টাকা একবারেই পাওয়ার কথা শ্রমিকদের।’’ ধীরেনবাবুর ক্ষেত্রে তাহলে এই ব্যতিক্রম কেন?

মেঘনা জুটমিলের এক কর্তা বলেন, ‘‘গ্র্যাচুইটির প্রশ্নে কিছু গরমিল হয়েছে ঠিকই। ওই শ্রমিকের ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে দেখে তবেই মন্তব্য করা সম্ভব।’’ তবে রাজ্যের অধিকাংশ চটকলেরই দৈন্য অবস্থার কথা স্বীকার করে নিয়ে শ্রমমন্ত্রী জানান, অনেক সময়েই ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’ মেনে নিয়ে চটকলের শ্রমিকেরা ইউনিয়ন ও মালিক পক্ষের সঙ্গে বৈঠকের সমঝোতা মেনে নেন। যে সমঝোতায় শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি দু’তিন কিস্তিতে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। তবে তা মেলে কিনা তার উত্তর মেলেনি। মন্ত্রীর আশ্বাস, ‘‘বিষয়টি শ্রম কমিশনারকে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’’

কেন্দ্রে ক্ষমতা বদলের পরে, শ্রমিকদের পাওনা সংক্রান্ত এমনই অজস্র দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বারস্থ হয়েছিল হুগলির চন্দননগরের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সাড়াও মিলেছিল দ্রুত। তবে, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে রাজ্যের প্রায় সাড়ে ৩০ হাজার শ্রমিকের পাওনা-গন্ডা সংক্রান্ত সমস্যা দ্রুত মিটিয়ে ফেলার নিদের্শ দেওয়া হলেও শ্রম দফতরের গয়ংগচ্ছ মনোভাবের যে বদল হয়নি, ধীরেনবাবুর পোস্ট ডেটেট চেক পাওয়া তারই নমুনা।

চালু চটকলগুলির অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের অধিকাংশের এমন নানান অভিজ্ঞতা আছে। ‘অবসরপ্রাপ্ত জুট মিল শ্রমিক মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন সম্প্রতি এ ব্যাপারে রাজ্যের চারটি জেলায় সমীক্ষা করে পরিসংখ্যান দিচ্ছে— অবসর নেওয়ার পরেও অন্তত ৩০,৪০০ জন শ্রমিক এখনও তাঁদের গ্র্যাচুইটির টাকা হাতে পাননি। আবার অনেকের পাওনাই ঝুলে রয়েছে কিস্তির অনিশ্চয়তায়। এ ব্যাপারে মামলা করলে তা-ও ঝুলে থাকছে অনন্তকাল ধরে।

রাজ্যের পরিবেশ দফতরের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন-অফিসার বিশ্বজিত্‌ মুখোপাধ্যায় দীর্ঘ দিন ধরেই চটকল শ্রমিকদের বিনা পারিশ্রমিকে আইনি সহায়তা করছেন। চন্দননগরের ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা লড়ছেন তিনিই। এই ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা, “মামলা যত প্রলম্বিত হবে শ্রমিকরা ততই পিছু হটবেন, এটা মিল মালিকেরা জানেন। কারণ অভাবী শ্রমিকের মামলা চালানোর খরচ জোগানোর সামর্থই নেই। তার উপর তাঁদের অনেকেই পেশার টানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘ দিন কাজ করার সুবাদে এখন রোগাক্রান্ত। ফলে অবসরকালীন নানা রকম ভাতার অভাবে ঠিক মতো চিকিৎসাও করাতে পারছেন না।’’ মেঘনা জুটমিলের ধীরেন দাস সেই তালিকায় অন্যতম। হৃদরোগাক্রান্ত ধীরেনবাবু ওই চটকল কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে আবেদন করেছিলেন। ফলমিলেছে তাতে, তিনি বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন তদ্বিরের শেষে আমাকে পাঁচটি চেক দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে, চলতি বছরের নভেম্বর, সেপ্টেম্বর ’১৬, অক্টোবর ’১৭, মে ’১৮ এবং জানুয়ারি ’১৯ সালের। আমারা প্রাপ্য প্রায় ১.৩০ লক্ষ টাকা। কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ প্রতি কিস্তিতে সাকুল্যে ১২ হাজার টাকা করে পাঁচ কিস্তিতে ৭২ হাজার টাকা দিতে সম্মত হয়েছেন।’’

এ অবস্থায় শ্রম আদলতের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। কিন্তু তার রায় মিলবে কবে, কেউ জানেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন