এই সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। নিজস্ব চিত্র।
সকাল সাড়ে ১১টা। হাসপাতালের বারান্দায় ছোট্ট লাইনে কয়েকজন মহিলা শিশুকোলে দাঁড়িয়েছিলেন। এক মহিলা জানলার কাছে গিয়ে এক মহিলাকে বললেন, ‘‘দিদি ক’দিন ধরে ছেলের জ্বরটা কমছে না।’’ পরের জন বললেন, ‘‘পেটের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছি। একটু কড়া ডোজের ওষুধ দিন।’’ সেটুকু শুনেই ‘দিদি’ ঝটপট ওষুধ দিয়ে দিলেন। না কোনও পরীক্ষা, না কোনও পরীক্ষার পরামর্শ।
‘দিদি’ হলেন মগরাহাটের গোকর্ণী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক মাত্র নার্স। একাধারে চিকিৎসারও দায়িত্বে। কারণ, তিনি ছাড়া ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিষেবা দেওয়ার দ্বিতীয় কেউ নেই।
বহু বছর আগে মগরাহাট ২ ব্লকে গোকর্ণী পঞ্চায়েতে প্রায় ৯ বিঘা দানের জমির উপরে ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হয়েছিল। সংখ্যালঘু ও তপসিলি অধ্যুষিত এলাকার মানুষজন ভেবেছিলেন, রাতবিরেতে আর রোগী নিয়ে দূরদূরান্তে ছুটতে হবে না।
শুরুর পরে বেশ কয়েক বছর সব ঠিকঠাকই চলছিল। সে সময়ে ৬ বেডের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট ছিলেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য ছিল আবাসন। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, ধীরে ধীরে ভেঙে পড়েছে গোটা পরিকাঠামোটাই।
গত কয়েক বছর ধরে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক অনিমিয়িত। ফার্মাসিস্ট শেষ কবে ছিল, তা প্রবীণেরাও মনে করতে পারেন না। অধুনা আবাসনগুলির মধ্যে কয়েকটি স্থানীয় কিছু লোকের কব্জায় চলে গিয়েছে। কয়েকটি আবাসন ঝোপ-জঙ্গলে ঢাকা। বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপখোপের বাস। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশের মাঠ গরু-ছাগলের চারণভূমি। ইমারতি কারবারের ইট-বালি রাখা সেখানে। কখনসখনও ম্যাটাডর, ট্রাকও দাঁড়িয়ে থাকে।
অভিযোগ, সন্ধ্যার পরে অসামাজিক কাজকর্মের আড্ডাখানা হয়ে দাঁড়ায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বর। মদের আসর বসে। যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগের ফলে দুর্গন্ধ সর্বত্র।
এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একমাত্র নার্স ছাড়া আছেন এক অস্থায়ী মহিলা সাফাইকর্মী। নার্স ছন্দা কয়াল জানালেন, চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী না থাকায় বাধ্য হয়ে তিনি সব সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি জানালেন, এক সময়ে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতি দিন ৩০০-৪০০ রোগী আসতেন। এখন সংখ্যাটা তলানিতে ঠেকেছে। পাশের একটি ঘরে আয়ুবের্দিক চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে কিছু ভিড় হয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামো ভেঙে পড়ায় সমস্যায় পড়েছেন তাঁরা। বিশেষত জরুরি পরিস্থিতিতে বা প্রসূতিদের নিয়ে জেরবার মানুষ। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঠিকঠাক পরিষেবা না মেলায় রোগীকে নিয়ে ছুটতে হয় বারুইপুর, বা ডায়মন্ড হারবার জেলা হাসপাতালে। সে জন্য ১৫-২০ কিলোমিটার রাস্তা পার করতে হয়। মুমূর্ষু রোগী বা প্রসূতিদের ক্ষেত্রে যা যথেষ্ট ঝুঁকির। যাতায়াত খরচসাপেক্ষও বটে। রোগী নিয়ে যেতে দিয়ে দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতাও আছে কারও কারও।
মগরাহাট ২ পঞ্চায়েতের জনস্বাস্থ্য স্থায়ী সমিতির সদস্য এবং স্থানীয় বাসিন্দা জাফর আলি মোল্লা বলেন, ‘‘এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে জুগদিয়া, গোকর্ণী পঞ্চায়েত-সহ বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ একসময়ে নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু পরিষেবা দিতে না পারায় অনেকে আর এমুখো হতে চাইছেন না।’’ তিনি জানান, চিকিৎসক নিয়োগ-সহ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সার্বিক উন্নয়নের দাবিতে কিছু দিন আগেই জেলাশাসক ও স্বাস্থ্য দফতরের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।
সমস্যার কথা মেনে নিয়ে মগরাহাট ২ বিএমওএইচ মহম্মদ গওসউল আলম বলেন, ‘‘যদি কোনও চিকিৎসক না থাকতে চান, তা আমি আর কী করতে পারি!’’ তাঁর দাবি, নানা সময়ে একাধিক চিকিৎসককে পাঠানো হলেও নানা অজুহাত দেখিয়ে তাঁরা চলে গিয়েছেন।’’ সমস্ত বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএমওএইচ।