পুরভোট ২০১৫: কামারহাটি

‘মদন-মত্ত’ তৃণমূল, ভোট কাটার অঙ্ক কষছে অন্যেরা

তিনি থেকেও নেই। আসলে কিন্তু না থেকেও তিনি আছেন! কামারহাটির বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী মদন মিত্র। এলাকার বিধায়ক থেকে রাজ্যের মন্ত্রী— সমস্ত পদেই রয়েছেন তৃণমূলের শীর্ষস্থানীয় এই নেতা। সারদা-কাণ্ডে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে থাকায় পুরভোটের প্রাক্কালে কামারহাটি জুড়ে তিনি সশরীরে উপস্থিত নেই ঠিকই, তবে এলাকা থেকে কয়েক যোজন দূরত্বে থাকা সত্ত্বেও কামারহাটি পুর-ভোটের রিমোট কিন্তু রয়েছে মদনের হাতেই।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০১:২৪
Share:

তিনি থেকেও নেই। আসলে কিন্তু না থেকেও তিনি আছেন!
কামারহাটির বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী মদন মিত্র।
এলাকার বিধায়ক থেকে রাজ্যের মন্ত্রী— সমস্ত পদেই রয়েছেন তৃণমূলের শীর্ষস্থানীয় এই নেতা। সারদা-কাণ্ডে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে থাকায় পুরভোটের প্রাক্কালে কামারহাটি জুড়ে তিনি সশরীরে উপস্থিত নেই ঠিকই, তবে এলাকা থেকে কয়েক যোজন দূরত্বে থাকা সত্ত্বেও কামারহাটি পুর-ভোটের রিমোট কিন্তু রয়েছে মদনের হাতেই।

Advertisement

আর তাই বোধ হয় কামারহাটির তৃণমূল কর্মীরা বলছেন, ‘‘দাদা আমাদের হৃদয়ে। তাঁর ছায়াতেই পুর-যুদ্ধ লড়ছি।’’ বিরোধীরাও অবশ্য একই কথা বলছেন। কামারহাটির প্রাক্তন বিধায়ক তথা সিপিএম নেতা মানস মুখোপাধ্যায় যেমন বলেন, ‘‘জেলে বসেই উনি (মদন মিত্র) ছড়ি ঘোরাচ্ছেন।’’ তৃণমূলকর্মী থেকে বিরোধী প্রত্যেকের কথাই যে সত্যি, তার প্রমাণ মেলে কামারহাটিতে হোর্ডিং-ব্যানার দেখলেই। সর্বত্রই প্রার্থীর নামের পাশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিধায়ক মদনের ছবি।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যাঁকে সিবিআই সারদা মামলায় গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে, তাঁর ছবি প্রচারে ব্যবহার করা কি ঠিক?

Advertisement

স্থানীয় তৃণমূল নেতা তথা বিদায়ী চেয়ারম্যান গোপাল সাহা বলেন, ‘‘সবটাই কর্মীদের আবেগ। সিবিআই আগে প্রমাণ করুক মদন মিত্র দোষী। তখন ভাবা যাবে, তাঁর ছবি ব্যবহার করা হবে কি না।’’

কামারহাটি পুরসভায় ৩৫টি আসন। প্রতিটিতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রার্থী দিয়েছে শাসক দল তৃণমূল। তবে কামারহাটির রাজনৈতিক মহলে কান পাতলেই শোনা যায়, ২০-২২টি আসনের প্রার্থীই মদন-ঘনিষ্ঠ। আবার দলীয় সূত্রের খবর, মদনই প্রথমে প্রার্থী তালিকা তৈরি করে জেলা নেতৃত্বের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে হাতে গোনা কয়েক জন প্রার্থী যোগ-বিয়োগ করা হয়েছে মাত্র। উত্তর ২৪ পরগনার তৃণমূল জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘কামারহাটিতে মদন এখনও দলের বিধায়ক-মন্ত্রী। তাই ওঁর পাঠানো তালিকা নিয়ে সাংসদ সৌগত রায় ও জেলার পর্যবেক্ষক নির্মল ঘোষের সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা তৈরি হয়েছে।’’

বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ভাষাভাষীর মানুষের বসবাস। সঙ্গে কিছুটা শিল্পাঞ্চল। এই কামারহাটি চিরকালই বামেদের দুর্গ বলে পরিচিত। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুও এই বিধানসভা এলাকা থেকেই বেশ কয়েক বার ভোটে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েছিলেন। তবে ২০১০-এর পুরভোট থেকেই বামেদের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে তৃণমূল। ৩৫টি আসনের মধ্যে ১৮টি দখলে রেখে বামেরা পুরবোর্ড গড়লেও ১৭টি আসন পেয়েছিল তৃণমূল।

২০১১-র বিধানসভা ভোটে কামারহাটিতে প্রথম আঘাত হানে তৃণমূল। প্রায় ২৪ হাজার ভোটে হেভিওয়েট সিপিএম প্রার্থী মানস মুখোপাধ্যায়কে হারিয়ে সেখানে জোড়া ফুল ফোটান মদন মিত্র। এক দিকে বিধায়ক, অন্য দিকে রাজ্যে ক্ষমতায় নিজেদের দল— এই জোড়া ফলাকে হাতিয়ার করে কামারহাটি পুরসভায় বিরোধী আসনে বসে তৃণমূল। কিন্তু সিপিএমের টানা পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করার আগেই পুরসভার ক্ষমতায় চলে আসে শাসকদল তৃণমূল। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে কামারহাটির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর যোগ দেন তৃণমূলে। তাতে পুরসভায় আসন বৃদ্ধি হয় শাসক দলের।

সিপিএমের ঘর ভাঙার এই খেলাতেও বাজিমাত করেছিলেন মদনই। তাঁর প্রভাবেই আফসানা খাতুন নামে ওই কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ সিপিএমের। যদিও এ বার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ওই তৃণমূল প্রার্থীর দাবি, ‘‘আমার উপরে কেউ কোনও প্রভাব খাটাননি। মানুষের জন্য কাজ করতে এবং নিজের ইচ্ছেতেই সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েছিলাম।’’

পুরবোর্ডে ক্ষমতা বদলের পরেই আসে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন। বিধানসভার তুলনায় এই লোকসভা ভোটে সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূলের ব্যবধান কমে প্রায় ৯ হাজার ভোটে। পুরসভার নিরিখে তৃণমূল জয়ী হলেও ৩৫টি আসনের ৭টিতে জয়ী হয় বামেরা। আবার মোদী হাওয়ায় বিজেপি-ও ২০ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে যায়। সেই ভোট এ বার অনেকটা বাড়বে বলে মনে করেন উত্তর শহরতলির বিজেপি-র জেলা সভাপতি গোপাল সরকার। তিনি বলেন, ‘‘ওটা মানুষের ভোট ছিল না। সবই ছিল মদনের খেলা। কামারহাটিতে বিজেপি-র নিজস্ব একটা ভোট আছে। এ বার তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপি-র লড়াই হবে। জেলে বসেও কামারহাটি নিয়ন্ত্রণ করছেন মদন মিত্র।’’ কংগ্রেসের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তাপস মজুমদার বলেন, ‘‘মদন মিত্র জেলে থেকেও যে ভাবে সব নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাতে ভয় হচ্ছে ওঁর লোকেরা ভোটটা আদৌ করতে দেবেন কি না।’’

উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মানস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জেলে বসে উনি যতই ছড়ি ঘোরান, মার খাব তবু বুথ ছাড়ব না। মানুষ তৃণমূলকে বুঝে গিয়েছে। তাই অবাধ নির্বাচন হলে আমরাই বোর্ড গঠন করব।’’ কিন্তু সিপিএম কামারহাটিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে, তা নিয়ে সংশয়ে দলের শীর্ষ মহল। কারণ এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক মানসবাবু ও সিটু নেতা সুভাষবাবু আক্রান্ত হওয়ার পরেও তা নিয়ে এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন ভাবে কোনও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে উঠতে দেখা যায়নি। তবে কামারহাটি পুরসভায় ক্ষমতায় আসতে না পারলেও নিজস্ব ভোটব্যাঙ্কের জোরে কয়েকটি আসন সিপিএম পেতে পারে বলেও মনে করছেন জ্যোতিপ্রিয়বাবু।

কামারহাটি জুড়ে মদন-হাওয়া বইলেও এক দিকে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল এবং অন্য দিকে পুরনো হেভিওয়েট সিপিএম নেতারা প্রার্থী হওয়ায় কি‌ছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে তৃণমূল। যেমন ১০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী হয়েছেন ৪১ বছর ধরে পুরসভায় ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারম্যান পদে থাকা আশি-পেরোনো গোবিন্দ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর বিপক্ষে তৃণমূলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তৃণমূলের স্বপন মণ্ডল। দু’জনে ওই ওয়ার্ডেরই বাসিন্দা। স্বপনবাবু পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন। আবার এখানেই গোঁজ প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন একদা মদন-ঘনিষ্ঠ অসীম মিত্র।

রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, অসীম ও স্বপনের মধ্যে ভোট কাটাকাটিতে লাভবান হতে পারেন গোবিন্দবাবু। যদিও তা মানতে নারাজ স্বপনবাবু। বলেন, ‘‘লড়াই হলেও এ বার গোবিন্দবাবু বুঝবেন হারার ব্যথা কতটা।’’ ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে আবার সাংসদ সৌগত রায় ঘনিষ্ঠ ও এলাকার শ্রমিক নেতা বলে পরিচিত বিমল সাহার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন প্রাক্তন সিপিএম চেয়ারম্যান তমাল দে। এ ছাড়াও, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে টিকিট না পেয়ে নির্দলে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূলের কাউন্সিলর তাপস শূর। তবে সিপিএমের পুরনো হেভিওয়েট প্রার্থীদের কথা বাদ দিলে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন জ্যোতিপ্রিয়বাবুরা। তাঁর কথায়, ‘‘নির্দল নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। তৃণমূলের যাঁরা নির্দলে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের আগেই বিভিন্ন কারণে শোকজ করা হয়েছে।’’

সব মিলিয়ে এখন দেখার ‘মদন-ময়’ কামারহাটিতে কতটা ভেল্কি দেখাতে পারেন জেল-বন্দি মদন মিত্র!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন