ঠাকুরনগর

মেলার আকাশে উড়ছে শুধু লাল-সাদা নিশান

ভোটের মুখে রাজনৈতিক দলের পতাকায় নয়, ঠাকুরনগরের আকাশ ছেয়েছে লাল-সাদা নিশানে। ওই নিশান মতুয়াদের। আজ, সোমবার থেকে ঠাকুরনগরে শুরু হচ্ছে মতুয়াদের ধর্ম মহামেলা। তাই রবিবার থেকেই ভিড় জমতে শুরু করেছে।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও সীমান্ত মৈত্র

কলকাতা ও বনগাঁ শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:০৫
Share:

বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ভক্তদের নাচ। বাঁ দিকে, দল বেঁধে আসছেন ভক্তরা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

ভোটের মুখে রাজনৈতিক দলের পতাকায় নয়, ঠাকুরনগরের আকাশ ছেয়েছে লাল-সাদা নিশানে।

Advertisement

ওই নিশান মতুয়াদের। আজ, সোমবার থেকে ঠাকুরনগরে শুরু হচ্ছে মতুয়াদের ধর্ম মহামেলা। তাই রবিবার থেকেই ভিড় জমতে শুরু করেছে।

পক্ষাঘাতে গত কয়েক বছর শয্যাশায়ী ছিলেন। সুস্থ হয়ে অনেককাল পর মতুয়া মেলায় ডঙ্কা-কাঁসির তালে পা মেলালেন জলপাইগুড়ির ৫০ বছররে প্রৌঢ়া সুদামা বিশ্বাস। রবিবার বিকেল ৫টা। ঠাকুরনগরের চিকনপাড়ার কাছে ঠাকুরবাড়ির সামনে ক্যানিং থেকে আসছিল আরেকটি দল। সেখান থেকে বছর কুড়ির একটি মেয়ে জড়িয়ে ধরলেন সুদামাকে। ‘‘ও পিসি কেমন আছো!’’ সুদামা বললেন, ‘‘সাত বছর আসতে পারিনি। এত বছর পরে দেখা। ও আমার ভাইঝি।’’

Advertisement

যেন ‘মিনি’ ভারতবর্ষ! রবিবার থেকেই ডঙ্কা-কাঁসির তালে ভাসছে ঠাকুরনগর। সেই তালের সঙ্গে পায়ের ছন্দ মিলেয়ে মুখে ভক্তদের ‘হরি বোল’ ধ্বনি। বিভিন্ন রাজ্য তো বটেই, বাংলাদেশ থেকেও দলে দলে ভক্তেরা আসছেন। আজ, সোমবার সন্ধ্যা থেকেই শুরু হবে পুণ্যস্নান। ঠাকুর বাড়ির কামনাসাগরে ডুব দিলেই ‘পাপমুক্তি’, বিশ্বাস এমনই। এরপরেই ঠাকুরবাড়িতে পুজো। ভিজে শরীরে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ মন্দিরের সামনে শুরু হবে ডঙ্কা-কাঁসির সঙ্গে নাচ। তারপরে ‘বড়মা’ দর্শন, প্রণাম।

মতুয়া ধর্মের প্রাণপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশীতে প্রতি বছরের এই সময়ে পুণ্যস্নানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এই মেলা। শুরুটা অবশ্য হয়েছিল অবিভক্ত বাংলাদেশের ওরাকান্দিতে। দেশভাগের পরে ঠাকুরবাড়ির সদস্য প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের উদ্যোগে ঠাকুরনগরে শুরু হয় এই মেলা। দিনে দিনে মেলা কলেবরে বেড়েছে। এক সময়ে সাংসদ, এমনকী রাজ্যের মন্ত্রীও ছিলেন প্রমথরঞ্জন। তাঁর স্ত্রী বীণাপাণিদেবীই (বড়মা) এখন সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা। প্রথমরঞ্জনের হাত ধরেই প্রথম রাজনীতি ঢোকে ঠাকুরবাড়িতে। তাঁর ছোট ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ গত বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের হয়ে জিতে মন্ত্রী হন। লোকসভা ভোটে ওই দলের হয়েই সাংসদ হন বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে লোকসভা উপ-নির্বাচনে ঠাকুরবাড়ির কোন্দল প্রকাশ্যে আসে। মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন মঞ্জুল। তাঁর ছেলে সুব্রতকে প্রার্থী করে ভোটের লড়াইয়ে নামে বিজেপি। কপিলকৃষ্ণের স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুর ঠাকুরপোকে ভোটে হারিয়ে তৃণমূলের সাংসদ হন।

এরপর থেকে মেলা পরিচালনার মূল দায়িত্ব বর্তায় সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি মমতাবালার উপরেই। তবে, রাজনীতির সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী এই মেলাকে মেশাতে রাজি নন পশ্চিম মেদেনীপুরের পিংলার কমলা জানার মতো অনেকেই। সুদামা, কমলাদেবীর মতো ভক্তদের অভ্যর্থনায় ত্রুটি রাখেনি ঠাকুরনগরও। প্রতিটি বাড়ির উঠোন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে অতিথিদের জন্য। কিছুটা অবস্থাপন্ন বাসিন্দারা উঠোনে বাঁশ পুঁতে সামিয়ানা, নীচে চট বিছিয়ে দিয়েছেন। এক উঠোনে ছোট-ছোট চুল্লিতে পাশাপাশি রান্না করছে কোচবিহার এবং বিহার থেকে আসা পুণ্যার্থীরা। ভাত-ডাল, সব্জি।

বিহারের পূর্ণিয়া থেকে এসেছেন রাকেশ বিশ্বাস, সুধীর মণ্ডল, নকুল দাসেরা। রবিবার দুপুরে স্থানীয় একটি মাঠে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তাঁরা। জানালেন, মেলার সময় বাড়ি বসে থাকতে পারেন না। ঠাকুরের টানে ফিরে আসেন। ঠাকুরনগর খেলার মাঠে জলসত্রে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন উত্তর দিনাজপুরের কমলকান্ত বিশ্বাস। তিনি জানান, ৬৫ জনের দল নিয়ে এসেছেন। এখানকার দু’টি পরিবার থেকে ইতিমধ্যেই খাওয়ার ডাক পেয়েছেন। ঠাকুরনগরে এটাই তাঁরা আশা করেন।

‘‘মেলা এখন শুধু মতুয়া ভক্তদেরই নয়,’’ বললেন মেলা কমিটির পুরনো সংগঠক হরিনারায়ণ মজুমদার। বস্তুত, মতুয়া না হলেও দূরদুরান্ত থেকে মানুষ মেলায় ছুটে আসেন। তাঁদেরই এক জন অসমের গোকুল দাস। দলে মোট ২৩জন। গোকুলবাবু বলেন, ‘আমরা মতুয়া নই। ঠাকুরনগরের মেলার নানা কথা শুনেছি। তাই নিজের চোখে মেলা দেখতে চলে এসেছি।’’

দেশি-ভিন্ দেশি ভক্তদের এখন সামলাতে ব্যস্ত ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুরবাড়ি চিরে চলে গিয়েছে পাকা রাস্তা। একপাশে নানা দোকান। পিছনে রেল লাইন। সেই লাইনের পাড়ে নাগরদোলা থেকে শুরু করে মরণকুপ, চক্ররেল। অন্য পাশে সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের ঠাকুরবাড়ি। পরিষ্কার করা হয়েছে কামনা সাগরের জল।

ওই জলেই তো আজ থেকে শুরু হবে পুণ্যস্নান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন