চোখ-কান বুজে ঘর ছেড়ো না, বলছেন মেয়েরা

উত্তর ২৪ পরগনার নানা প্রান্তে পাচার হয়েও ফিরে আসা এমন ১৯ জন তরুণী এখন এই কাজে নেমেছেন। তৈরি করেছেন ‘উত্থান’ নামে একটি সংগঠন। গত তিন বছর ধরে কাজের সূত্রে এখন বহু ধরনের অভিজ্ঞতা এই মেয়েদের ঝুলিতে। তাঁদের সঙ্গে একই কাজ করছে ৮টি সংগঠন নিয়ে তৈরি ‘পাটনার্স ফর অ্যান্টি ট্র্যাফিকিং’ নামে একটি সংগঠন।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৮ ০১:৪৫
Share:

লড়াই: পাচারকারীদের হাত থেকে ফিরে জীবনের মূলস্রোতে ফেরার যুদ্ধ। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

বাংলাদেশি যুবকের প্রেমের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন বাগদার তরুণী। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয় যুবক। বছর চারেক আগে তরুণী কাউকে কিছু না জানিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে বাড়ি ছাড়েন। কিন্তু সংসার করার সাধ মেয়েটি। প্রেমিক তাঁকে মহারাষ্ট্রের যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দিয়েছিল।

Advertisement

তবে হাল ছাড়েননি তরুণী। স্থানীয় কয়েক জনের সাহায্যে দিন কুড়ি পরে বাড়ি ফিরে আসতে পেরেছিলে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তরুণী জানালেন, প্রেমের অভিনয় ধরতেই পারেননি তিনি।

কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না, ফিরে আসার পরের জীবনের সমস্যাগুলোর কথা। ভালবেসে ঘর বাঁধার স্বপ্নের অনেক বড় মাসুল গুনতে হয়েছে তাঁকে। তরুণী জানালেন, নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হত। পাড়া-পড়শিরা রাস্তায় দেখলে মুখ ঘুরিয়ে নিত। নানা কটূক্তি উড়ে আসত। মনে হত, এই বিপর্যয়ের জন্য যেন মেয়েটিই দায়ী।

Advertisement

কিন্তু ভেঙে পড়েননি তরুণী। বাবা-মা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে মনের জোর পান। ফের পড়াশোনা শুরু করেন। বিএ প্রথমবর্ষ পর্যন্ত লেখাপড়া করে একটা ছোটখাটো কাজও খুঁজে নেন। এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মতো আরও যে মেয়েরা পাচার হয়ে কোনও না কোনও ভাবে ফিরে এসেছে, তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই সামিল হয়েছেন বাগদার এই তরুণী। এই সব মেয়েদের সামাজিক ও আইনি অধিকার রক্ষা, সামাজিক সম্মান ফিরিয়ে দিতে মরিয়া তিনি।

উত্তর ২৪ পরগনার নানা প্রান্তে পাচার হয়েও ফিরে আসা এমন ১৯ জন তরুণী এখন এই কাজে নেমেছেন। তৈরি করেছেন ‘উত্থান’ নামে একটি সংগঠন। গত তিন বছর ধরে কাজের সূত্রে এখন বহু ধরনের অভিজ্ঞতা এই মেয়েদের ঝুলিতে। তাঁদের সঙ্গে একই কাজ করছে ৮টি সংগঠন নিয়ে তৈরি ‘পাটনার্স ফর অ্যান্টি ট্র্যাফিকিং’ নামে একটি সংগঠন।

ওই সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৬ সালের পরে উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় ১২১ জন পাচার হওয়া মেয়েকে তারা দিল্লি, মুম্বই নেপাল, কলকাতা থেকে উদ্ধার করে এনেছে।

সোমবার বনগাঁয় বিডিও অফিসের সভাঘরে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে পাচার হয়ে ফিরে আসা মেয়েরা জীবনের সেই সব ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা বললেন। অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। সকলেরই একই বক্তব্য, ‘‘এমন ঘটনা যেন অন্য কোনও মেয়ের জীবনে না ঘটে।’’

অনেকেরই অভিজ্ঞতা, যাদের জন্য পাচার হয়েছিলেন তাঁরা, অনেকে এখনও দিব্যি আইনের চোখে ধুলো দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর তাঁদের মতো প্রতারিতদের মুখ লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। স্বরূপনগরের এক তরুণীর কথায়, ‘‘আমাকে যে পাচার করে যৌনপল্লিতে বিক্রি করেছিল, তার কোনও শাস্তি হয়নি। বরং বাড়ি ফিরে আসার পরে আমাকে আর আমার পরিবারের লোকজনকে ওরা খুনের হুমকি দিয়েছিল।’’ তরুণী জানান, দুষ্কৃতীদের শাস্তির জন্য এখনও লড়ে যাচ্ছেন তিনি।

মেয়েদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেল, শুধু প্রেমের অভিনয় নয়, পাচারের আরও কত ফন্দি-ফিকির ব্যবহার করে দুষ্কৃতীরা। কখনও কাউকে চাকরির টোপও দেওয়া হয়। জেলায় জেলায় কর্মশালা করে এই মেয়েরা এখন বোঝাচ্ছেন, চোখ-কান বন্ধ করে কাউকে বিশ্বাস করে মেয়েরা যেন বাড়ি না ছাড়েন।

উদ্যোক্তাদের অন্যতম শম্ভু নন্দা বলেন, ‘‘আমাদের জেলায় নারীপাচার বড় সমস্যা। পাচার হয়ে ফিরে আসা মেয়েরা আইনি সাহায্য পাচ্ছেন না। সামাজিক সম্মানও হারাচ্ছেন। সরকার থেকেও কোনও সুযোগ সুবিধাও মেলে না এই মেয়েদের।’’ তিনি জানান, জেলা থেকে ১৩টি মেয়ে পাচার হয়ে ফিরে আসার পরে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করে সরকারের কাছে আবেদন করেছিল। ৭ টি আবেদন ইতিমধ্যেই বাতিল হয়েছে।

তবে মেয়েরাও ছাড়ার পাত্রী নন। তাঁরা জানিয়েছেন, নিজেরাই নিজেদের অধিকার বুঝে নেবেন। নিজেদের পায়ে দাঁড়াবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন