কৌশল: পোকা মারবে এই যন্ত্রই। —নিজস্ব চিত্র।
স্বাদে খাসা। চাহিদা দেশের সীমানা ছা়ড়িয়ে বিদেশও বাড়ছে। কিন্তু বাংলার রকমারি বেগুন বিদেশে সে ভাবে রফতানি করা যাচ্ছে না। কারণটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। আগে যা ছিল তাই— কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার।
তার ফলে আনাজের মাধ্যমে আমাদের শরীরে সেঁদোচ্ছে ক্ষতিকর বিষ। তাই বিদেশের বাজারে ডাহা ফেল করে যাচ্ছে বাংলার আনাজ।
বিষ প্রয়োগ না করেও এ বার পোকা ধরার প্রযুক্তি চাষির খেতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করল উত্তর ২৪ পরগনা উদ্যানপালন বিভাগ। কিছুটা পুরনো ফেরোমন ফাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন প্রযুক্তি। সৌর চালিত বাতি-ফাঁদ।
দফতরের কর্তাদের দাবি, এই আলো এবং হরমোনের টোপে পোকারা এসে সহজেই ফাঁদে পড়ে মরছে। দেগঙ্গা, আমডাঙা, বারাসতের যে সব চাষিরা এই বাতি-ফাঁদ ব্যবহার করছেন, মাত্র কয়েক দিনে তাঁদের কীটনাশকের খরচ প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। তাতে চাষের খরচ কমে বাড়ছে লাভও। সব থেকে বড় লাভ, পাতে পড়ছে বিষহীন আনাজ।
কৃষি বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বেগুনের পোকা আটকানো প্রায় অসম্ভব। কারণ, এই পোকা ফল বা বেগুন ফুটো করে ভিতরে ঢুকে যায়। এই পোকার নাম ‘ফ্রুট অ্যান্ড শুট বোরার’। বাংলায় বলা হয় ছিদ্রকারী পোকা। উত্তর ২৪ পরগনার সহ-উদ্যানপালন অধিকর্তা শুভদীপ নাথ জানান, বেগুনের পোকার পূর্ণাঙ্গ অবস্থা হচ্ছে মথ। এরা পাতার নীচের দিকে ডিম পাড়ে।
পোকার লার্ভা ছোট বেগুনের নীচের দিকে ফুটো করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। বেগুন খেয়ে পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় তারা বেগুনের উপরের দিক ফুটো করে বাইরে বেরিয়ে আসে। পোকায় খাওয়া বেগুন বাজারে বিক্রি করা যায় না।
এই পোকা জব্দ করার উপায় কী?
কৃষি বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, পোকার বংশবৃদ্ধি বন্ধ করাই একমাত্র পথ। হরমোন বাতি-ফাঁদ সেই কাজটাই করছে।
কী ভাবে?
বেগুন খেতের পোকারা নিশাচর। ফলে রাতে ছাড়া তাদের মারার উপায় নেই। কীটনাশক দিনে স্প্রে করা হয়। নতুন বাতি-ফাঁদের উপরে রয়েছে একটি সৌরবাতি। দিনে সূর্যের আলো তা চার্জ হয়। অন্ধকার হলে নিজে থেকেই জ্বলে ওঠে। তার নীচে রয়েছে একটি প্লাস্টিকের পাত্র। সেই জল ভর্তি পাত্রে কেরোসিন বা সামান্য কীটনাশক মিশিয়ে রাখা হচ্ছে।
সেই পাত্রের সঙ্গে লাগানো দু’টি ছোট প্রকোষ্ঠে থাকছে ফেরোমন ট্যাবলেট। এটি আসলে হরমোন। মিলনের জন্য মেয়ে পোকাদের দেহ থেকে যে হরমোন বের হয়। সেই হরমোনের গন্ধে এবং বাতির আলো লক্ষ্য করে পুরুষ পোকারা এসে বিষ-জলে পড়ছে। তার ফলে পোকার বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না। শুভদীপ বলেন, ‘‘কীটনাশক স্প্রে করলে পোকার ডিম বা লার্ভা নষ্ট হয়। কিন্তু বাতি-ফাঁদে পূর্ণাঙ্গ পোকা মরে।’’
দেগঙ্গার একটি ফার্মার্স ক্লাবের প্রধান সুদর্শন মণ্ডল এই বাতি ফাঁদের কাজে উৎফুল্ল। বললেন, ‘‘সপ্তাহখানেকের ব্যবহারে বেগুন খেতে পোকার দাপট প্রায় কমে গিয়েছে। কীটনাশকের খরচ প্রায় শূন্য। আমাদের এলাকা থেকে বিদেশে অনেক আনাজ যায়। কিন্তু বিষের ব্যবহারের জন্য তা বাতিল হয়ে যেত। আশা করি, এ বার আর তা হবে না।’’
একটি যন্ত্রের দাম প্রায় আটশো টাকা। একটি যন্ত্র দু’মরসুমের বেশি ব্যবহার করা যাবে। চাষিরা বলছেন, এক মরসুমে এক বিঘা বেগুন খেতে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার কীটনাশক ছড়াতে হয়। এটি বিক্রি করছে ফার্মার্স-প্রোডিউসার্স অর্গানাইজেশন (এফপিও)। বারাসত ১ ব্লকের এফপিও-র প্রধান শঙ্কর জানা নিজের জমিতেও বসিয়েছেন এই যন্ত্র। এক বিঘা জমিতে একটি যন্ত্রই যথেষ্ট বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।