এই সেই মন্দির। নিজস্ব চিত্র।
মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি নাটমন্দির। সঙ্গে রয়েছে বাবা ভোলানাথের মন্দির। সেই মন্দিরের ভিতরে আছে বিশাল একটি শিবলিঙ্গ ও মা মনসার মূর্তি। রয়েছে রাধাগোবিন্দের মন্দিরও। তার মধ্যে রাধাগোবিন্দ, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি। আছে একটি তুলসী মন্দির। মন্দিরের মধ্যে আছে শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী দেবীর ভুবন ভোলানো মূর্তি। রাস্তার পাশে একটি তোরণ। তাতে বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি। এমনই চিত্র বনগাঁর গাঁড়াপোতার শ্রী শ্রী কালী মন্দিরের।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার প্রাচীনতম কালীপুজোর মধ্যে এটি একটি অন্যতম পুজো বলে পরিচিত। মন্দিরটির কিছু ঐতিহাসিক গুরুত্বও রয়েছে। সাড়ে চারশো বছরের পুরনো এই কালীপুজো। কালীপুজোর দিন দেবী দর্শনে বিভিন্ন এলাকা থেকে ভক্তেরা আসেন। তা ছাড়া, ওই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে নানা অলৌকিক কাহিনী। বিপদে পড়ে কেউ মায়ের কাছে এলে তিনি বিপদ থেকে উদ্ধার হবেনই, এমনই ধারণা মানুষের মধ্যে।
প্রয়াত ইতিহাসবিদ শশধর চক্রবর্তীর ‘ইতিহাসের আলোকে যশোহর বনগাঁর পাঁচশত বছর’ নামে একটি বই থেকে ও মন্দির কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৫৮৫ সালে অর্থাত্ ৪২৯ বছর আগে এই দেবীর পুজোর প্রচলন করেছিলেন যশোহরের রাজা বিক্রমাদিত্যের পুত্র যুবরাজ প্রতাপাদিত্য রায়। যুবক প্রতাপাদিত্য রাজ্যে বীর যোদ্ধা বাছাই করতে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। প্রতাপাদিত্যের মানসিকতা ক্রমশ মোগল বিরোধী হয়ে উঠছিল বলে পিতা বিক্রমাদিত্যের সন্দেহ হয়। ওই একটি প্রতিযোগিতায় এক পরাজিত তিরন্দাজ এক জয়ী তিরন্দাজকে আক্রোশবশত হত্যা করেন। যুবক প্রতাপাদিত্য তখন রাগে ওই খুনি তিরন্দাজের মুণ্ডু কেটে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। ওই তিরন্দাজের বাবা বিক্রমাদিত্যের কাছে ছেলের হত্যার প্রতিবাদ করে বিচার প্রার্থনা করেন। বিক্রমাদিত্য ছেলেকে নির্বাসনে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
বুদ্ধি করে বিক্রমাদিত্য ছেলেকে আগ্রায় মোগল দরবারে পাঠিয়ে নির্বাসন দণ্ড কার্যকর করেন। দ্রুতগামী বজরা নিয়ে ইছামতী নদী পেরিয়ে গঙ্গা দিয়ে প্রতাপাদিত্য কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে আগ্রায় পৌঁছন। মোগল দরবারে কয়েক বছর থেকে তিনি যশোহরের দিকে রওনা দেন। সে সময়ে তিনি স্বপ্নে দেখতে পান, শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী মা অধিষ্ঠান করছেন এক বনভূমিতে।
মন্দির পরিচালন সমিতির সম্পাদক বিভূতি বিশ্বাস বলেন, “মন্দিরের পশ্চিম দিকে যে বাওর রয়েছে, সেটি অতীতের ইছামতী নদী। প্রতাপাদিত্য স্বপ্নে দেখা এলাকা হিসাবে এখানে তার বজরা নোঙর করেছিলেন বলে অনুমান করা হয়। কয়েকজন সৈনিক নিয়ে বনভূমিতে নেমে তিনি অনেক খোঁজার পরে অরক্ষিত অবস্থায় মাতৃমূর্তি প্রত্যক্ষ করেন।” মন্দির পরিচালন সমিতি সূত্রে জানা যায়, সেই বনভূমির কাছে গাঁড়াপোতা এলাকা থেকে কিছু মানুষকে ডেকে মায়ের পুজোর নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রতাপাদিত্য। সে সময়ে দেবীর পুজো চলত একটি পর্ণকুটিরে। লোকমুখে শোনা যায়, ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানিও সিদ্ধেশ্বেরী মায়ের কাছে এসে আর্শীবাদ নিয়েছিলেন।
কালী মন্দিরটি স্থানীয় গাঁড়াপোতা গোবরাপুর ও কুন্দিপুর মৌজার সংযোগস্থলে অবস্থিত। মন্দিরের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে বনগাঁ-বাগদা সড়ক। প্রতাপাদিত্যের নির্দেশে পুজো চালু হওয়ার পরে পরবর্তী সময়ে ইট-কাদার দেওয়াল ও টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি ছোট্ট মন্দিরে মায়ের পুজো চলত। মন্দিরটি বর্তমানে এক একর সাতাশ শতক জমির উপরে। অতীতে এখানে পুজো কোন নিয়মে হত, তা সঠিক ভাবে বলা যাবে না। বিভূতিবাবু বলেন, “১৩৮৪ বঙ্গাব্দ থেকে দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণী মন্দিরের প্রচলিত নিয়মে পুজো হয়ে আসছে।” পুরনো ভগ্নপ্রায় মন্দিরটি ভেঙে ২০০৯ সাল থেকে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী মন্দিরের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। বহু মানুষের দানের টাকায় এটি নির্মিত হচ্ছে। শেষ হতে এখনও দুই বছর সময় লাগবে বলে মন্দির কমিটি জানিয়েছে।