শাসনে যাত্রীপ্রতীক্ষালয়। সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।
সন্ধ্যা নামছে। সবে ছুটির ঘণ্টা বেজেছে দুগদিয়া পলতাডাঙা হাইস্কুলে। নিমেষে কয়েকশো পড়ুয়ার কোলাহলে সরগরম শাসন রোড। শহরতলির আর পাঁচটা জায়গার সঙ্গে যেন কোনও তফাত নেই শাসনের।
অথচ কয়েক বছর আগেও ছবিটা ছিল আলাদা। শাসনের এই স্কুলটি তখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ছিল। স্কুলদখল নিয়েছিল সেনাবাহিনী। স্কুলের সামনেই রাস্তার উপরে বালির বস্তার ব্যারিকেডের পিছন থেকে উঁকি দিত ভিন রাজ্যের সামরিক জওয়ানের হেলমেট। বস্তার উপরে তাক করে রাখা থাকত কালাশনিকভ, এ কে ফর্টি সেভেন। এক বছর মহাসপ্তমীর সকালে খুন হ’ন একজন। বন্ধ হয় শাসনের সে বারের শারদোৎসব। আর একবার রমজান মাসে একজন খুন হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে যায় খুশির ঈদ। শাসনের দখল নেয় সেনারা।
এখন শাসনে বারাসত থানা ভেঙে নতুন থানা হয়েছে। বেশ কিছু রাস্তা পাকা হয়েছে। রাস্তায় আলোও লেগেছে। পাকা নর্দমা হওয়ায় বর্ষাতেও জল দাঁড়ায়নি বেশির ভাগ রাস্তায়। শাসন রোডের পাশে তৈরি হয়েছে যাত্রী প্রতীক্ষালয়। যদিও অটো, বাস, যানবাহন এখনও যথেষ্ট নয়, বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
তবে স্বচ্ছ ভারত মিশনের দৌলতে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু শৌচালয়। ফলে আগের চাইতে অনেকটাই আবর্জনামুক্ত হয়েছে শাসন। লাজুক হাসিতে বৃদ্ধ মৎস্যচাষি হাসান মোল্লা বলে ওঠেন, ‘‘মাঠেই যেতাম সারা জীবন। এখন ঘরেই কাজ সারি।’’
এখনও পঞ্চায়েত এলাকার আওতাভূক্ত হলেও, শাসন ক্রমশ শহরতলির চেহারা নিচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছে।
এক সময় প্রায় পুরোটাই জলাভূমি ছিল শাসন, তথা বারাসত ২ নম্বর ব্লক। বিদ্যাধরী নদীর একটি খাল চলে গিয়েছিল শাসনের বুক চিরে। সেই নদীর উচুঁ জমি ভরাট করে তৈরি হয় বসতি। নিচু জলা জমিতে চলে মাছ চাষ। মাত্র কয়েকজন জমিদারের দখলে ছিল গোটা এলাকা।
এলাকার বৃদ্ধদের কথায়, ১৯৩০ সাল থেকে শুরু হয় বাঁধ দিয়ে ভেড়ি করে মাছ চাষ শুরু করেন এলাকার কিছু জমিদার। ভেড়ি ব্যবসা লাভজনক হয়ে ওঠার পর ১৯৫০ সাল নাগাদ শুরু হয় তার দখল নিয়ে হানাহানি। ‘যার লাঠি, তার ভেড়ি’ নীতি কায়েম হল শাসনে। হাজার-হাজার বিঘের খাস জমির দখল নিল জনা আঠারো প্রভাবশালী ব্যক্তি। পরবর্তী কালে রাজনৈতিক দলগুলো যোগ দেয় লড়াইয়ে।
ছবিটা বদলে যায় ১৯৭৭ সালে। বাম আমলে ‘অপারেশন বর্গা’ আন্দোলনের ফলে ওই ১৮ পরিবারের দখল থেকে ১০ হাজার বিঘার মতো জমি খাস করে, তার পাট্টা বিলি হয় ১৫ হাজার পরিবারের মধ্যে। সমবায় করে জলা জমিতে মাছ, এবং কৃষক সভা করে ডাঙায় ধান, সব্জি চাষ শুরুর পরিকল্পনা নেন এলাকার বাম নেতারা।
কিন্তু সমাজতন্ত্রের সেই স্বপ্নের পথে এগোন যায়নি। সমবায় ও কৃষক সভায় ঢুকে পড়ে রাজনীতি। একজোট হয়ে চাষের পরিবর্তে প্রচুর টাকায় পয়সাওয়ালা মানুষকে ‘লিজে’ ভেড়ি চাষ করতে দেওয়া হয়। শুরু হয় টাকা তছরুপ, ভাগ নিয়ে গোলমাল। মারপিট, খুনোখুনির জন্য পরিচিত হয়ে ওঠে শাসন। বছর পাঁচেক আগে একবার ছ’নম্বর ভেড়িতে ঢুকেই মনে হল, এ যেন অন্য জগৎ। কয়েকশো যুবকের হাতে দূর পাল্লার বন্দুক। ব্যাগের মধ্যে বোমা। এক চালার ঘরে সার দিয়ে রাখা নানা অস্ত্র। অভিযোগ ছিল, গোটা রাজ্য পুলিশের কাছে যতো অস্ত্র রয়েছে, তার চেয়ে বেশি অস্ত্র আছে শাসনে।
তখন বিরোধীরা ঢুকতে পারত না শাসনে। তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরেও বিরোধীদের সে ভাবে উপস্থিতি নেই। মজিদ মাস্টার স্বয়ং ঘরছাড়া। তবে গণতন্ত্র মজবুত না হোক, আইনশৃঙ্খলার হার কিছুটা ফিরেছে, বলছেন এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ। পাকদহের গৃহবধূ আফসানাবিবির কথায়, ‘‘স্বামী এখন কলকাতায় মাছ বিক্রি করতে যেতে পারছে। রাতে বাড়িও ফিরে আসছে। শান্তির কারণ সেটাই।’’
তাই কি? খতিয়ে দেখতে ফের যাওয়া গেল ছ’নম্বর ভেড়ি এলাকায়। সেখানে এখন অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি হচ্ছে শিশু উদ্যান। পিকনিক গার্ডেন। ভেড়ির নীল জল ঘেরা সবুজ এলাকাটি যেন ‘বহিরাগত’ মানুষকেও নিমন্ত্রণ করছে সাদরে। তবে কি বদলে গিয়েছে শাসন?
(চলবে)