স্টেডিয়ামের কাজ শেষ হল না এখনও। ডান দিকে, মাতলার চরেই চলছে ম্যাচ প্র্যাকটিস। —নিজস্ব চিত্র।
মাতলার চরে স্পোর্টস কমপ্লেক্স গড়া নিয়ে বহু কথা খরচ করেছে রাজ্য সরকার। সুন্দরবনের খেলাধূলার প্রসারে এই উদ্যোগ কতটা সুদুরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন ক্যানিংবাসীও। কিন্তু প্রস্তাবিত সেই স্পোর্টস কমপ্লেক্সের কাজ আজও শেষ হয়নি। স্থানীয় মানুষজনের অভিযোগ, পরিকল্পনা ও পরিকাঠামোর অভাবে ক্যানিংয়ের খেলাধূলার গ্রাফ ক্রমশ নিম্নমুখী।
গোটা ক্যানিং শহরে খেলার মাঠ কার্যত নেই বললেই চলে। সবুজ ঘাসের অভাবে ক্যানিংয়ের ফুটবলে এখন ভাটার টান। অথচ একটা সময়ে ফুটবলকে কেন্দ্র করেই উন্মাদনার জোয়ার বইত ক্যানিংয়ে। কয়েক দশকে এই মহকুমা শহর অনেক ফুটবলারের জন্ম দিয়েছে। দিলীপ কয়াল, তিমির মণ্ডল, কার্তিক সাহা, ম্যানুয়েল, সুকুমার রুদ্র, খ্রিষ্ট, হরেন ঘোড়ুই, মিন্টু রায়, অমিত সাঁফুই, অজয় ঘোষরা সুনামের সঙ্গে কলকাতা ময়দানে দাপিয়েছেন। চম্পাহাটি জোনের ম্যাচ দেখতে ভিড় ভেঙে পড়ত। চির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যানিং স্বস্তিকা সঙ্ঘ এবং ক্যানিং রিক্রিয়েশন ক্লাব মুখোমুখি হলে টানটান উত্তেজনায় ফুটত এলাকা। ফুটবলের সেই সুদিন অবশ্য অতীত। কয়েক বছর আগে ওই প্রতিযোগিতা বন্ধই হয়ে যায়।
স্বস্তিকা সঙ্ঘ গত উনিশ বছর ধরে নকআউট ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। নানা কারণে ওই প্রতিযোগিতাও বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। মাতলা ২ পঞ্চায়েত এবং ক্যানিং ১ পঞ্চায়েত সমিতির সহযোগিতায় তা অবশ্য হয়নি। তবে এই প্রতিযোগিতায় এখন তৃতীয় শ্রেণির বিদেশি ফুটবলারের ছড়াছড়ি। ফুটবলপ্রেমীদের বক্তব্য, বর্তমানে ছেলেরা সে ভাবে মাঠে আসছে না। কম্পিউটার বা টিভির দিকেই তাদের ঝোঁক অনেক বেশি। সকলেই কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। তবে মাঠের অভাব ফুটবলকে ক্রমশ পিছনের সারিতে ঠেলে দিচ্ছে বলে তাঁদের দাবি। গ্যাব্রিয়েল স্কুলের মাঠে এক সময় প্রতিযোগিতা হত। কলকাতায় প্রথম ডিভিশনে খেলা অনেক ফুটবলার এই মাঠে বল পায়ে নেমেছেন। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওই মাঠে খেলা বন্ধ করে দেয়। শহরের এক প্রাক্তন ফুটবলারের আক্ষেপ, “সুযোগ-সুবিধা না থাকায়, একটু নাম করলেই কোনও ফুটবলার এখানে পড়ে থাকে না। মানুষও যেন ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়েছে।”
এলাকাবাসীর অনুযোগ, বাম আমলের শেষ দিকে স্পোর্টস কমপ্লেক্স তৈরির কথা ঘোষণা করা হয়। বছর কয়েক আগে কাজও শুরু হয়। কিন্তু কাজ কবে শেষ হবে, কেউ জানে না। ফুটবলপ্রেমীদের অনেকেরই বক্তব্য, রাজ্য সরকার ক্যানিংয়ে ফুটবল অ্যাকাডেমি তৈরি করুক। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পরেশরাম দাস বলেন, “আগে স্বস্তিকা সঙ্ঘের প্রতিযোগিতা হলেই হুজুগে মেতে উঠতাম।” তাঁর কথায়, “বর্তমানে কোনও ভাল খেলোয়াড় উঠছে না। এ নিয়ে আমরা ভাবনাচিন্তা শুরু করেছি। সরকারি ভাবে কোনও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় কিনা, দেখা হচ্ছে।”
খেলাধূলার মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা দেশে ক্যানিংকে সব থেকে বেশি পরিচিতি দিয়েছে সাঁতার। গত কয়েক দশকে এই জনপদ কম সাঁতারুর জন্ম দেয়নি। বিশ্বজিত্ দে চৌধুরী, মহানন্দা নন্দী, হেমন্ত দেবনাথ, দিপালী দাস, ইন্দ্রনীল দাস, মুকুল হালদার, নাসের, আকবর আলি মীর, দিলীপ মণ্ডলের মতো সাঁতারুরা যথেষ্ট নাম করেছেন। বিশ্বজিত্ সাইয়ের কোচ হয়েছিলেন। কিন্তু এত সাফল্য সত্ত্বেও সাঁতারেও পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। গোটা ক্যানিংয়ে একটিও স্যুইমিং পুল নেই। সাঁতার কোচ কেশব দাস নিরলস প্রচেষ্টায় ক্যানিংয়ের পানাপুকুরে বহু সাঁতারু তৈরি করেছেল। বললেন, “আগে কোনও পড়ুয়া সাঁতারে সফল হলে স্কুল হাফ-ছুটি দিত। আর এখন....।” ক্যানিংয়ের অনেক সাঁতারুই খেলার সুবাদে ভাল জায়গায় চাকরি পেয়েছেন। অথচ এই খেলাতেও পরিকাঠামো নিয়ে প্রশাসন বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়, আক্ষেপ সাঁতারুদের। অধিকাংশ সাঁতারুই গরিব পরিবার থেকে উঠে আসা। জলে নেমে কঠোর পরিশ্রম করার পরে ভাল খাবার জোটে না অনেকেরই।
ওয়াটার পোলোতেও ক্যানিংয়ের নামডাক রয়েছে। রফিকুল শেখ, পুষ্প বণিক, রমেন বৈদ্য, শিবু ঘোষের মতো খেলোয়াড় উঠে এসেছেন এই খেলা থেকে। এই খেলার সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই ক্ষোভ, অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্য ওয়াটারপোলোর মান নেমেছে অনেকটাই। শিবুবাবু বলেন, “প্রাক্তন খেলোয়াড়রা যদি কিছুটা সময় দেন, তা হলে ক্যানিংয়ের সাঁতার আর ওয়াটারপোলো আবার সেই মানে পৌঁছে যাবে।”
(চলবে)