ক’দিন ধরেই ঘুমোতে পারছিলাম না। কাল সারারাত এ পাশ-ওপাশ করেছি। আজ (বৃহস্পতিবার) রায় শোনার পরে একটুও কান্না পেল না।
মা অবশ্য খুব কান্নাকাটি করছিলেন। বাবা তো কাঁদতে পারেন না, তিনি চুপ করে গিয়েছেন। আজকাল কোনও কিছুই যেন তাঁকে আর স্পর্শ করে না। একটাই ছেলে তো! তার উপরে আবার সবার ছোট।
রায় শোনার সময় আমার ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু চোখ দিয়ে একফোঁটা জলও বেরলো না। চোখগুলো মনে হয় শুকিয়ে গিয়েছে!
আমাদের পড়াশোনা হয়নি বেশি দূর। কাজে ঢুকেছিলাম। ভাইকে পড়াচ্ছিলাম কষ্ট করে। এখনও ভাবি, কেন যে সেই রাতে আমাকে আনতে গেল ও! আমি না-হয় একাই ফিরতাম। ওরা আমার গায়ে মদ ঢালত, অসভ্যতা করত। তাতে আর কী হতো? ওদের একটা চড় মারতাম। হয়তো পাল্টা মার খেতাম। কিন্তু আমার আদরের ছোট ভাইটা তো বেঁচে যেত!
কাল (বুধবার) আসলে সারারাত এই সব ভাবতে ভাবতে কেঁদেছি। সে জন্যই হয়তো আজ আর চোখে জল নেই। তিন বছর পর কাল রাতে ‘আনন্দবাজার’-এর সঙ্গে ওই এলাকায় গিয়েছিলাম। সেই স্টেশন চত্বর, সেই আদালত। সেই জায়গাটা। ভাইকে যেখানে ওরা বারবার ছুরি মারছে আর আমি পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছি। সারা রাত ধরে এ সব কথাই মনে হচ্ছিল। আমার ভাইয়ের মতো ভাল ভাই কারও নেই। ও প্রাইভেট টিউশন পড়বে বলে কেটারিং-এ একটা কাজ নিয়েছিল। আমি শুনে খুব রাগারাগি করেছিলাম। বলেছিলাম, “আরও টাকা লাগবে তো আমাকে বলিসনি কেন? আমি কলকাতায় যাই, সারাদিন কাজ করি, এত পরিশ্রম করি সবই তো তোর পড়াশোনার জন্য! আর তুই পড়াশোনা নষ্ট করে কাজ ধরেছিস!”
আজ ও যদি থাকত, তা হলে কলেজে পড়ত।
সেই রাতটার কথা সব সময় মনে পড়ে। সে দিন সাইকেলে ওঠার পর আমাকে বলেছিল, ‘বাড়ি চল, একটা জিনিস দেখাব।’ বললাম, ‘কী জিনিস?’ ও বলল, “দেখে তুই আমাকে খুব আদর করবি।’ আমি বললাম, ‘কী বল!’ বলল, ‘পরীক্ষার (মাধ্যমিক) অ্যাডমিট কার্ড।’
কে জানত, ভাইয়ের সেই অ্যাডমিট কার্ডের ছবি দু’দিন পরে কাগজে কাগজে ছাপা হবে! এটা সহ্য করা যায়?
এত দিন লোকে আমার সঙ্গে বারবার কথা বলতে চেয়েছে। সব মিডিয়া তাদের অফিসে যেতে বলেছে। আমি কোথাও যাইনি। কথা বলিনি। শুধু এই চার বছরে ১২ থেকে ১৩ বার সাক্ষী দিতে যেতে হয়েছে আদালতে। ওই ঘটনার পর আমি আর বাড়ি থেকে বেরোই না। কিন্তু যত বার সাক্ষী দিতে ডেকেছে, সময়ের আধ ঘণ্টা আগে চলে গিয়েছি। আদালতে বলেছি, ‘স্যার, আমার ভাই খুব ভাল ছিল। ওরা এমনি এমনি আমার ভাইকে খুন করে ফেলল! ওদের শাস্তি চাই।’
আজ আমি কথা বলব সবার সঙ্গে। আমার অনেক কথা বলার আছে। আমার ভাইয়ের খুনিরা গ্রেফতার এবং আজকের এই সাজা এটা কিন্তু মিডিয়া আমার পাশে ছিল বলেই হয়েছে।
তবু আমার একটা প্রশ্ন আছে। চার দিকে এত ঘটনা ঘটছে। এত কাণ্ড ঘটছে। কোনও বদল হয়েছে কি? প্রতিদিন একের পর এক অপরাধের ঘটনা বেড়েই চলেছে। তাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি না হলে অপরাধ কমবে কী করে?
যে ছেলেগুলো আজ দোষী সাব্যস্ত হল, সেই ছেলেগুলোকে দেখেছিলাম দমদম সেন্ট্রাল জেলে। টিআই প্যারেডে। সেই চোখ! আমি সহ্য করতে পারিনি। অতগুলো লোকের মধ্যে চোখ দেখেই তো চিনতে পারলাম। সারা শরীরের যত শক্তি ছিল জড়ো করে মারলাম গালে একটা চড়। তার পর আর কিছু মনে নেই। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
আমার ভাই খুব ভাল ভাই। নিষ্পাপ ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে। ওর কী দোষ ছিল? আচ্ছা, কারও দিদির সঙ্গে কেউ যদি অসভ্যতা করে গায়ে মদ ঢেলে দেয়, ছোট্ট ভাইকে প্রেমিক ভেবে ‘ভ্যালেন্টাইন, ভ্যালেন্টাইন’ করে তা হলে কোনও ভাই কি সহ্য করতে পারে? আমার ভাই-ও পারেনি। ও পারেনি ওদের সঙ্গে লড়াই করতে। কারণ ওরা তিন জন ছিল। আমি সব জায়গায় ছুটেছি। পুলিশ-প্রশাসনের লোক সবাইকে হাতজোড় করে বলছি, আমার ভাইকে ওরা খুন করছে, আপনারা চলুন! একটা কেউ গেল না! এই মানুষদের উপরে রাগ হবে না?
আমি আর কিছু বলতে পারছি না। আমার শরীর খারাপ লাগছে।