ED Raid in Sandeshkhali

কর্তারা বসতেই প্রাণভয়ে গাড়ি ছোটান সে দিন, ১৯ দিন পর মঙ্গল আবার সেই শাহজাহানের ডেরায়

গত ৫ জানুয়ারি সরবেড়িয়া গ্রামে তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে গিয়ে স্থানীয়দের হামলার মুখে পড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল প্রাণ হাতে করে। ১৯ দিন পর আবার সেই একই জায়গায়।

Advertisement

সারমিন বেগম

সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:৩৩
Share:

ইডির গাড়ির চালক মঙ্গল রজক (বাঁ দিকে), আগের দিন হামলায় ভাঙা গাড়ি (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র।

দৃশ্য এক— মরণপণ দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসলেন কয়েক জন ইডি আধিকারিক এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান। গাড়ি স্টার্ট করে রাখাই ছিল। সবাই উঠতেই অ্যাক্সিলারেটরে জোর চাপ দিলেন চালক। গাড়ি ছুটল। চার পাশে হইচই, আগুন। লাঠির ঘা পড়ছে। মাঝখান দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল গাড়ি। স্পিডোমিটার দেখাচ্ছে গতি ১০০ পেরিয়েছে। প্রাণ বাঁচলে তবে না অন্য কথা!

Advertisement

দৃশ্য দুই—চারপাশ ফাঁকা। রাস্তাঘাটে মানুষ নেই, তার চেয়ে বেশি পুলিশ। সিআরপিএফের সংখ্যা আরও বেশি। ইডির গাড়িতে স্টিয়ারিংয়ে বসে সেই একই চালক। অফিসাররা গাড়ি ছেড়ে তল্লাশিতে। তিনি চারপাশ দেখছেন আর মেলাচ্ছেন। সে দিন আর এ দিন। কুয়াশা ঢাকা শান্ত ভেড়ি থেকে উঠে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় মাঝে মাঝে চোখ লেগে আসছে।

১৯ দিনের ব্যবধানে উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির সরবেড়িয়া গ্রামের দৃশ্যপটের এই আমূল বদল ধরা পড়ল যাঁর চোখে তিনি মঙ্গল রজক। ইডির গাড়িচালক। আদতে ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা। গত ৫ জানুয়ারি সাদা এসইউভি চালিয়ে নিয়ে এসেছিলেন সন্দেশখালিতে। ২৪ তারিখ আবার যখন এলেন, গাড়ি বদলে গিয়েছে। এ দিনের এসইউভির রং ধূসর।

Advertisement

গত এক দশক ধরে কলকাতা শহরে গাড়ি চালাচ্ছেন মঙ্গল। সরকারি অফিসকাছারিতেই ভাড়া খাটেন বেশি। ৫ তারিখ তিনি সন্দেশখালির অকুস্থলে পৌঁছে ইডি অফিসারদের নামিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ইটভাঁটার কাছে। আচমকাই খবর আসে, পালাতে হবে। মঙ্গল দেখেন, ইটভাঁটার ভিতর থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসছেন ইডি আধিকারিকেরা। মুখেচোখে উদ্বেগ, গাড়ির কাছে দৌড়ে এসে তাঁরা বলেন, ‘‘এখনই বেরোতে হবে এলাকা ছেড়ে। যে ভাবে হোক।’’ সে দিন বিকেলে সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালের চত্বরে দাঁড়িয়ে মঙ্গল আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘‘কয়েক জন ইডি কর্তা এবং কেন্দ্রীয়বাহিনীর জওয়ান হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লেন গাড়িতে। আমিও ছুটিয়ে দিলাম গাড়ি।’’ কিছুটা এগোতেই মঙ্গলের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করল ছবিটা। তাঁর কথায়, ‘‘আসার সময় দেখি, রাস্তার উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের সঙ্গে আসা গাড়িগুলো। প্রায় প্রত্যেকটিতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। শাহজাহান মার্কেটের কাছে আগুনও জ্বলছে! রাস্তাঘাটে ভিড় করে রয়েছেন প্রচুর লোকজন। বুঝতে পারছিলাম গন্ডগোল বড় রকমের। আমাদের চিনতে পারলে বিপদ বাড়তে পারে।’’

গাড়ির ভিতরে ইডির অফিসারেরা। মঙ্গল বুঝতে পারছিলেন সবার নিরাপত্তা এখন তাঁর হাতে। একই সঙ্গে তাঁর নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবেও আতঙ্ক হচ্ছিল। মঙ্গল বলেন, ‘‘বুঝতে পারছিলাম, নিজে বেঁচে অফিসারদের বাঁচিয়ে যে ভাবে হোক বেরোতে হবে এখান থেকে। আর সেটা করতে হবে লুকিয়ে। নিজেদের পরিচয় বুঝতে না দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। আমি গাড়ির গতি যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দিই। একটা সময়ে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি গতিতে গাড়ি চালিয়েছি। কিন্তু পিছন ফিরে তাকাইনি। মনে হচ্ছিল সেটা করলেও গাড়ির গতি কমে আসতে পারে।’’

কোনও রকমে প্রাণ হাতে করে হাসপাতালে পৌঁছে দম ফেলেছিলেন যে মঙ্গল, বুধবার সেই একই এলাকায় বসে থাকতে থাকতে ঘুমে চোখ লেগে আসছে তাঁর। কুয়াশা ঢাকা ভেড়ি থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস মঙ্গলের মনে করিয়ে দিচ্ছে গাঁয়ের কথা। কোথাও কিছু নেই, কেবল শনশনে ঠান্ডা হাওয়া ছাড়া। এতটাই নিস্তরঙ্গ আশপাশ। এই অবস্থায় মঙ্গলের সঙ্গে আবার দেখা আনন্দবাজার অনলাইনের। শুরুতেই প্রশ্ন, আজ (বুধবার) আবার সন্দেশখালি এলেন, ভয় লাগছে না কি? মুচকি হেসে মঙ্গল বলেন, ‘‘না। আজ আর ভয় নেই। ভয়ের কোনও কারণ নেই। এত জওয়ান চারপাশে ঘিরে রেখেছেন। সেই সঙ্গে রাজ্যের পুলিশও আছে। সব মিলিয়ে আজ আর ভয়ের কোনও কারণ নেই।’’ গত দিনের সঙ্গে এ দিনের ফারাক কী দেখলেন? এই প্রশ্নের জবাবে মঙ্গল বলেন, ‘‘সে দিন সব কিছুই অন্য রকম ছিল। এত লোক চারপাশে ঘিরে ধরছিল। আগুন, লাঠি, চিৎকার-চেঁচামেচি... আজ সব চুপচাপ। মনেই হচ্ছে না এখানেই আগের দিন এত কিছু হয়েছে!’’

মঙ্গল জানাচ্ছেন, গাড়ি নিয়ে পালানোর পথে বাজারের কাছে আগুন জ্বলতে দেখেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘মনে হয়, টায়ারে আগুন দেওয়া হয়েছিল।’’ তাঁর দাবি, যাওয়ার পথে অনেকগুলি গাড়ি ছড়িয়েছিটিয়ে পড়েছিল। সবক’টিই ভাঙাচোরা অবস্থায়। তার সঙ্গে এ দিনের পার্থক্য সহজেই অনুমেয়। বস্তুত, ইডির আধিকারিকেরাও যে আজ অকুতোভয় তা স্পষ্ট। ইডির এক তরুণ আধিকারিক, যিনি দুই অভিযানেই রয়েছেন, তাঁর মতে, বুধবার নিরাপত্তার বহর এতটাই বেশি যে, ভয় পাওয়ার বিষয়টিই নেই। একই সঙ্গে, তাঁর দাবি, বাইরের কোনও লোককেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। যে বাইরের লোকেরাই আগের দিন মূল গোলমালটি পাকিয়েছিলেন বলে ইডির দাবি।

মঙ্গল জানাচ্ছেন, দ্বিতীয় দিনে তাঁর গাড়িতে পাঁচ জন এসেছেন। অকুস্থলে পৌঁছে সবাই গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পর গাড়ি প্রতি একজন করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানকে মোতায়েন রাখা হয়েছে। মঙ্গলের কথায়, ‘‘গাড়ির সঙ্গে একজন করে সেন্ট্রাল ফোর্সের জওয়ান রয়েছেন। আমি নিশ্চিন্ত, আমার গাড়ির কিছু হবে না। আমি নিজেকে নিয়েও নিশ্চিন্ত। আমি সেফ (নিরাপদ) আছি।’’ সরকারি ডিউটিতে সাধারণত চালকদের আগে থেকে জানানো হয় না যে, পর দিন কোথায় যেতে হবে। মঙ্গলকেও জানানো হয়নি। বুধবার ভোরে ইডির কর্তা এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের নিয়ে বেরোন মঙ্গল। কোথায় যাবেন জানতেন না। কিন্তু ৫ জানুয়ারি যে রাস্তা ধরেছিলেন, বুধবারও সেই একই রাস্তায় যখন গাড়ি ছোটানো শুরু করলেন, বুঝতে অসুবিধা হয়নি গন্তব্য কোথায়। সঙ্গে এক কোম্পানি কেন্দ্রীয়বাহিনীর ‘ওমে’ ভয় ধারেকাছেও আসতে পারেনি। সকালেই বুঝে গিয়েছিলেন, সব মঙ্গলই হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন