ধাপাসের মাঠ তখন সরগরম।—নিজস্ব চিত্র।
খাটো মাঠ। বেঁটে গোলপোস্ট। ছোট্ট বল, সাকুল্যে দুশো গ্রাম।
উপচে পড়া মাঠে চলেছে ধাপাস টুর্নামেন্ট।
খেলাটা নতুন নয়। অন্তত দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার, লক্ষ্মীকান্তপুরের প্রান্তিক গ্রামগুলিতে শীত রোদের দুপুর জুড়ে ধাপাসের দাপট বেশ পুরনো। এ বার তার দাপটে মান খোয়াচ্ছে সাবেক ফুটবল। জেলার তাবড় ক্রীড়াবিদ থেকে দিনরাতের আটপৌরে ওয়ান-ডে ফুটবল আয়োজকদের তাই মাথায় হাত। চায়ের আড্ডায় উঁকি দিতে শুরু করেছে প্রশ্নওফুটবল কি তাহলে হেরে গেল ধাপাসের কাছে? কী এমন খেলা এই ধাপাস? আকারে নিতান্তই ছোট মাঠ। তাতে হাত তিনেক উচ্চতার এক্কেবারে বেঁটে তিন কাঠির পোস্ট-বার। আর রবার কিংবা ছোট আকারের ফুটবল। সরঞ্জাম বলতে এটুকুই। দু’দলে ভাগ করে প্রায় ফুটবলের নিয়মেই জনা দশেক খেলুড়ের বল পিটিয়ে গোলে পাঠানো। সহজ নিয়মের ধাপাস এমনই খেলা। ডায়মন্ডহারবারের স্থানীয় ক্লাবকর্তা আব্দুর রহমান মোল্লা বলছেন, “ফুটবলের মতো অত নিয়মকানুন নেই এ খেলায়। অফ সাইড নেই, গোলকিপারের বল ধরা নিয়ে অত জারিজুরি নেই। কাদা মাঠে কোনওরকমে ঠেলেঠুলে বল গোলে পাঠাতে পারলেই হল। গাঁয়ের মানুষ তাই এ খেলা খুব উপভোগ করেন।” যা শুনে প্রাক্তন ফুটবলার ডায়মন্ড হারবারের বাসিন্দা সুনির্মল চক্রবর্তীর আফসোস, “সমস্যাটা এখানেই। ছেলেরা ফুটবল ভুলে নিয়মের তোয়াক্কা না করে এই ধাপাসেই মেতেছে এখন।”
তিনি বলছেন, “ধাপাসের দাপটে এই এলাকায় ফুটবল ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।” সুনির্মল মনে করেন, ছোট বয়সে খেলাটা চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। তবে কিশোর বয়সের পরে ধাপাল খেললে ফুটবল ‘ভুলে’ যেতে বাধ্য। কেন? ইস্টবেঙ্গল তথা জাতীয় দলের হয়ে খেলা ওই ফুটবলারের ব্যাখ্যা, “প্রথমত ধাপাস বলটার কোনও নির্দিষ্ট সাইজ নেই। এই বল খেলা মানে ফুটবল খেলার ক্ষতি করা। তা ছাড়া এই খেলার নির্দিষ্ট নিয়মহীনতার ফলে পরে ফুটবলের সাবেক নিয়মগুলো রপ্ত করতেও অসুবিধা হচ্ছে বাচ্চাদের।” এআইএফের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোচ তথা রায়নগর সুনীলবরণ পৌর বিদ্যালয়ের শরীর শিক্ষার শিক্ষক চন্দন রায় বলেন, “ধাপাসকে হারাতে হলে, ফুটবলের চর্চা বাড়াতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে স্থানীয় ক্লাবগুলিকে।”
কিন্তু সে উপদেশ শুনছে কে! লক্ষ্মীকান্তপুরের ধাপাস খেলোয়াড় প্রবীর হালদার বলছেন, “ফুটবলের বড্ড নিয়মকানুন। তাই ধাপাসই খেলি। এ দিকে ওই খেলাটারই বেশি প্রচলন।” যা তাঁদের আয়ের পথও কিঞ্চিৎ খুলে দিচ্ছে। প্রবীর বলেন, “এতে ভাল আয় হয়। খেপ খেলে বেড়াই। হাত খরচার টাকাটা অন্তত তুলতে অসুবিধা হয় না।”
গুরুদাসনগরের কাছে মরুইবেড়িয়া পোলের মাঠে ১৭ বছর ধরে ধাপাস খেলার আয়োজন করে আসছে স্থানীয় ‘৭৮৬ সঙ্ঘ’। ক্লাবের কর্মকর্তা বাইজিদ মোল্লার দাবি, “ফুটবল খেলার চেয়ে এই খেলাটা এ দিকে জনপ্রিয়। সে কারণে আমরা প্রত্যেক বছর এই খেলার আয়োজন করি। এ বারও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩২টি দল নাম দিয়েছিল। ফাইনালে প্রথম পুরস্কার ছিল ২৫ হাজার টাকা।” কোথাও বা টাকার অঙ্কটা ৫০ হাজার। তিনি জানান, ধাপাসের ‘আদিকালে’ ন্যাকরা,বিভিন্ন জিনিসের ছিবরে এক জায়গায় জড়ো করে কাপড় দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধাপাস বল তৈরি করা হত। এখন অবশ্য তার জায়গায় ছোট ক্যাম্বিসের এমনকী ছোট মাপের রবার বা চামড়ার ফুটবলেও ধাপাস চলছে।
ডায়মন্ড হারবারের সরিষায় এই খেলা প্রথম শুরু হয় বলে দাবি করেছেন স্থানীয় মানুষজন। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায়। এখন কাকদ্বীপ, কুলপি, নামখানা, মথুরাপুর, লক্ষ্মীকান্তপুর, মন্দিরবাজার, রায়দিঘি-সহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ধাপাস ক্লাব। এলাকার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পূর্ব মেদিনীপুর থেকেও বিভিন্ন ক্লাব অংশ নেয় বলে জানা গিয়েছে। পূর্ব হোটরের প্রণব সঙ্ঘ নামে একটি ক্লাবের ক্রীড়া সম্পাদক প্রশান্ত সর্দার বলেন, “আসবে না কেন, ধাপাসের প্রতিযোগিতায় অনেক টাকা এসে পড়েছে যে!”
ধাপাসের সেই টাকার কাছেই কি হেরে যাচ্ছে ফুটবল?