অগুনতি মানুষ তখন নেমে পড়েছেন পুণ্যস্নান সারতে। বুধবার ঠাকুরনগরে নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।
বেলা ঠিক ২টো বেজে ৪২ মিনিট।
কামনাসাগরে যেন আর জল দেখা যাচ্ছে না। শুধু কালো কালো মাথার ভিড়। কেউ হাতের কাঁচা আম, শশা, কমলালেবু, সিঁদুর কৌটো ভাসিয়ে দিচ্ছেন জলে। কেউ এক গলা জলে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে হরিচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করছেন। আঁজলা ভরে ভক্তদের কেউ কেউ সেই জল পানও করছেন। মেলা কমিটির সম্পাদক ধ্যানেশনারায়ণ গুহ জানালেন, এ দিন দশ লক্ষেরও বেশি ভক্ত পুণ্যস্নান করেছেন।
বুধবার পুণ্যস্নান উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় ঠাকুরনগরে। কামনাসাগরের ঘোলা জল পাল্টাবার ব্যবস্থাও করেছে মেলা কমিটি। কিন্তু এত লোক সামলানোর জন্য প্রশাসনিক বা পুলিশি ব্যবস্থার খামতি পদে পদে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশ ত্রিবেদী বা মুকুল রায়েরা যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন না চাইতেও মতুয়া মেলায় মিলেছিল বাড়তি ট্রেন। এ বার আবেদন সত্ত্বেও একটিও বাড়তি ট্রেন জোটেনি রাজ্যের অন্যতম বড় মেলায়।
এমনিতে বনগাঁ লোকালে যাত্রা মানেই কাল ঘাম ছুটে যাওয়া। দিনরাত এই লাইনে বাদুরঝোলা হয়ে যাতায়াত করতে হয়। বনগাঁ থেকে শিয়ালদহের মধ্যে ৬৩টি ট্রেন চলে রোজ। তাতেও নাভিঃশ্বাস ওঠে যাত্রীদের। বাড়তি ভিড় সামলানোর জন্য এ বার কোনও বিশেষ ব্যবস্থা নেই। স্বাভাবিক ভাবেই নিত্যযাত্রীদের অবস্থা কাহিল। রেলপথে যে ভক্তেরা যাতায়াত করছেন, তাঁরাও আরামে নেই। এরই মধ্যে চলছে একাদশ শ্রেণির পরীক্ষা, উচ্চ মাধ্যমিক। ভিড়ের চাপে বারাসত স্টেশনে দাঁড়িয়ে একের পর এক ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে কেঁদে ফেলল কদম্বগাছি হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী রাবেয়া খাতুন। পরে অবশ্য রাবেয়ার ফোন পেয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে রাবেয়াকে স্কুলে পৌঁছে দেন বাবা সোহেয়াব হোসেন।
শুধু ট্রেন লাইনে নয়, সড়ক পথেও অব্যবস্থা। রাজ্যের কোনও জায়গা থেকে ঠাকুরনগর পর্যন্ত সরাসরি সরকারি-বেসরকারি বাস নেই। ট্রেনে ভিড় হবে, এই আশঙ্কায় বহু ভক্তই মেলায় বাস, ম্যাটাডর বা নিজস্ব গাড়ি নিয়ে আসেন। ফলে সড়ক পথে গাড়ির বাড়তি চাপ ছিল। যানজট এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-কলকাতাগামী পণ্য পরিবহণও। কালীপুজোর সময়ে বারাসতে যে ধরনের ট্র্যাফিক ব্যবস্থা থাকে, তার ছিটেফোঁটাও নজরদারি চোখে পড়েনি এ দিন।
গাফিলতি যে হয়েছে সে কথা স্বীকার করে উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “যশোর রোড থেকে ঠাকুরনগরে ঢোকার রাস্তাগুলি তেমন চওড়া নয় বলেই সমস্যা হয়। এত গাড়ি রাখার পার্কিংয়ের জায়গারও সমস্যা হয়েছে।” যদিও বনগাঁর এসডিপিও বিশ্বজিত্ মাহাতো আড়াইশো জন মহিলা-পুরুষ পুলিশ কর্মী নিয়ে যানজট সামলানোর চেষ্টা চালিয়েছেন। নিরাপত্তার দিকেও কড়া নজর রাখতে হয়েছে।
মেলার যখন তিলধারণের জায়গা নেই, সেই সময় হঠাত্ হঠাত্ লোডশেডিংয়ের জন্য নাজেহাল হতে হয়েছে মেলা কমিটিকে। সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক শীতল রায় বলেন, “মাঝে মধ্যেই বিদ্যুত্ চলে যাচ্ছে। বার বার বলা সত্ত্বেও পরিস্থিতির উন্নতি হল না মেলার দিনগুলোয়।”
কেন এই অব্যবস্থা?
জেলাশাসক মনমীত কউর নন্দা বলেন, “ছোট গলির জন্য যাতায়াতে ভিড় বেড়েছে। প্রয়োজনীয় কী কী দরকার তা-ও জানতে দেরি হয়েছে। তবে পরবর্তীতে আর সমস্যা হবে না।” রাজ্য সরকরের তরফেও কেন বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হল না? খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য বলেন, “ছাউনি করে থাকার জন্য আমরা ত্রিপল দিয়েছি। ২৫টি অস্থায়ী শৌচাগার, ৩৭টি নলকূপ করে দিয়েছি। মেডিক্যাল ক্যাম্পের জন্য ওষুধ, ব্লিচিং, চুন-সহ খাবারদাবারের জোগান দেওয়া হয়েছে।”
বুধবার পুণ্যস্নান শেষ হয়ে গেলেও মেলা চলবে আরও চার দিন। কোচবিহার থেকে ডঙ্কা বাজিয়ে একটি মিছিল তখন চিকনপাড়া দিয়ে ঠাকুরবাড়ি ঢুকছে, একটি মোটর বাইক এসে ধাক্কা মারল দলটিকে। দু’জন মহিলা চোট পেলেন। কিন্তু কোনও ঝামেলা বাধল না। সকলেই ক্ষমা চাইতে ব্যস্ত। সঞ্চয় সরকার বলেন, “এটাই মেলার বিশেষত্ব। কেউ যদি কাউকে অচেনা না মনে করে, তা হলে যে সৌজন্য দেখা যায়, সেটাই হয় এই মেলায় এলে।”
এত দিন সারা ভারতের অন্যান্য মন্দিরের মতো এই মেলাতেও প্রসাদ বিক্রি করা হত। এ দিন দেখা গেল নরোত্তম বিশ্বাসের মতো ভক্তদের প্রসাদ বিতরণ করতে। মতুয়া মহাসঙ্ঘের সভাপতি সুভাষ বিশ্বাস বললেন, “মমতা ঠাকুরের এই প্রথম নির্দেশে ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হল। বিক্রি করলে হয় তো অনেক টাকা হত। কিন্তু এমন ভালবাসা এই প্রথম পেলাম।”
সারা পৃথিবীর বিভিন্ন মেলায় ঘুরে বেড়ান বাউল শিল্পী শ্যাম খ্যাপা। মেলায় তাঁকে দেখা গেল গান গাইতে। ভিড় করে মতুয়া ভক্তরা বিভোর হয়ে শুনছিলেন। কেমন লাগছে মেলায় এসে? শ্যাম বলেন, “এ তো মনের মানুষের মিলনের মেলা।”
খালি গায়ে দুপুর থেকেই কামনা সাগরের পাশে ইতস্তত পায়চারি করছিলেন এক বৃদ্ধ মতুয়া। এসেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে। মাথায় জটা। পরনে ধুতি, ভাঁজ করে পড়া। বার বার এর ওর কাছে সময় জানতে চাইছিলেন। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ। ঘড়িতে তখন ২টো বেজে ৪২ মিনিট। এক মুহূর্ত দেরি না করেই তিনি মুখে জয় হরিচাঁদ, জয় গুরুচাঁদ ধ্বননি দিতে দিতে বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কামনাসাগরে। জল থেকে উঠতেই তাঁকে প্রণাম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অন্য ভক্তেরা। তত ক্ষণে পুণ্যস্নান করতে সাগরে নেমে পড়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। রাত ৮টা নাগাদ স্নান শেষ হল। এ বার ঘরে ফেরার পালা। হরিধ্বনির শব্দে তখনও আকাশ-বাতাস কাঁপছে।
ওপার বাংলার ওড়াকান্দি থেকে এসেছিলেন বছর সত্তরের এক বৃদ্ধ ভক্ত। বললেন, “দেহটাই শুধু ফিরে যাচ্ছে ঘরে। মনটা কিন্তু পড়ে থাকল ঠাকুরবাড়িতেই।”
(শেষ)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর ঠাকুরনগর’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা
চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।