অভিনব প্রেম-মেলা বনগাঁয়

মেলা থেকে প্রেম এনে দে

প্রেমের মেলা। আউল-বাউল-জয়দেব কিংবা হালফিলের মাটি উৎসবের বাইরে এ এক অন্য জগত। আকাশে-বাতাসে সবে লেগেছে বসন্তের রঙ-হাওয়া। তারই মাঝে, ফি বছর সরস্বতী পুজোর দিন বনগাঁ-বাগদা সীমান্তে বসে প্রেমের মেলা। ফুচকা-আলুকাবলি বিক্রি হয়। রঙিন বেলুন মেলে। মাঠে একটা সরস্বতী পুজোও হতো। এ বার অবশ্য চোখে পড়ল না। কিন্তু প্রতি বছর যা চোখে পড়বেই, তা হল অসংখ্য যুবক-যুবতী।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:১৪
Share:

প্রেম-যাপনে চলেছেন তরুণ-তরুণীরা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

প্রেমের মেলা।

Advertisement

আউল-বাউল-জয়দেব কিংবা হালফিলের মাটি উৎসবের বাইরে এ এক অন্য জগত। আকাশে-বাতাসে সবে লেগেছে বসন্তের রঙ-হাওয়া। তারই মাঝে, ফি বছর সরস্বতী পুজোর দিন বনগাঁ-বাগদা সীমান্তে বসে প্রেমের মেলা। ফুচকা-আলুকাবলি বিক্রি হয়। রঙিন বেলুন মেলে। মাঠে একটা সরস্বতী পুজোও হতো। এ বার অবশ্য চোখে পড়ল না। কিন্তু প্রতি বছর যা চোখে পড়বেই, তা হল অসংখ্য যুবক-যুবতী। কেউ প্রেমে গদগদ। কারও চোখ খুঁজছে মনের দয়িতকে। কেউ পেল, কেউ পেল না, তবু এই একটা দিনের টানে তাঁরা আসেন। সারাটা দিন কাটিয়ে ফেরেন পরের বছরের অপেক্ষা আর প্রত্যাশা মনে ধরে।

কোথায় হয় প্রেমের মেলা?

Advertisement

ভারত-বাংলাদেশ দু’দেশের সীমানার মাঝে রয়েছে উঁচু কাঁটাতার। তার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে বর্ডার রোড। কাঁটাতারের দু’দিকে তাকালে যত দূর চোখ যায়, শুধু আদিগন্ত সবুজ মাঠঘাট, খেত। এক দিকে, ও পার বাংলার ঘিবে ধানকুনি গ্রাম। এ পারে সুটিয়া ও বাঁশঘাটা। বর্ডার রোডের উপরে কংক্রিটের সেতু। নীচ দিয়ে বয়ে গিয়েছে কচুরিপানায় ঢাকা কোদালিয়া নদী। সেতুর এক পাশে বনগাঁর সুটিয়া। অন্য পাশে বাগদার বাঁশঘাটা গ্রাম। রাস্তায় চোখে পড়ে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা টহল দিচ্ছেন। বছরের আর পাঁচটা দিন ওই রাস্তায় যাতায়াত করতে হলে জওয়ানদের প্রশ্ন, খানাতল্লাশি চলে। অচেনা মানুষ হলে তো কথাই নেই। গাড়ি নিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে চলাচলের অনুমতিই নেই।

কিন্তু এমন এলাকায় শনিবারটা ছিল অন্য রকম। সাধারণ মানুষের অবাধ যাতায়াত। জওয়ানদের শাসন নেই। কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়। একটু ভুল বলা হল, ভিড়টা মূলত প্রেমিক-প্রেমিকাদেরই। নিভৃতে কিছুটা সময় কাটাতে আসেন তাঁরা। মেলায় আসা প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য থাকে না গুরুজনদের চোখ রাঙানি, নাক গলানো, অনুশাসন, এমনকী পরামর্শটুকু। হাতে হাত রেখে, রোদ পিঠ দিয়ে বয়ে যাওয়া দুপুরটা শুধু এখানে প্রেমিক প্রেমিকাদের। দু’টি প্রাণ নিভূতে হারিয়ে যায় যেখানে।

নীতি-পুলিশদের চোখ রাঙানি যখন সর্বত্রই, সেখানে এমন প্রত্যন্ত গ্রামে কী ভাবে শুরু হয়েছিল প্রেমের মেলা?

গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পারিবারিক আপত্তিতে আটকে গিয়েছিল স্মরজিৎ ও রূপাইয়ের প্রেম। কবি জসিমুদ্দিনের ‘নকশি কাঁথার মাঠ’-এ রূপাই-সাজুর প্রেম পরিণতি পায়নি। কিন্তু বাগদার রূপাই-স্মরজিৎ শেষ পর্যন্ত লড়ে গিয়েছিলেন। পারিবারিক নিষেধের তোয়াক্কা না করে বিস্তর লড়াই-ঝক্কি সামলে কোনও এক সরস্বতী পুজোর দিন তাঁদের চার হাত এক হয়েছিল। তাঁরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ভালবাসাকে সম্মান জানাতে তাঁরা সরস্বতী পুজোর দিনটি বিশেষ ভাবে উদযাপন করবেন। সেটা ছিল আজ থেকে প্রায় ছাব্বিশ বছর আগের ঘটনা। নিজেরা সেতুর কাছে ছোট করে পুজোর আয়োজন করেছিলেন। প্রথম দিকে পরিচিত প্রেমিক-প্রেমিকাদেরই ডাক দিতেন। একটা সময় পরে বিষয়টি জানাজানি হয়। দূরদূরান্ত থেকে যুগলের ভিড় বাড়তে থাকে।

কিন্তু রূপাই বা স্মরজিৎ একটা সময়ে অন্যত্র চলে যান। কোথা গেলেন, কেন ফিরে এলেন না আর, বাড়ির অন্য সদস্যেরাই বা কোথা গেলেন, সেটা বিশেষ জানা যায় না। তবে প্রেমের মেলা তার নিজের জায়গা করে নিয়েছে।

এ বছর গিয়ে দেখা গেল, সেতুর কাছে কোনও পুজো হচ্ছে না। সেটি একটু দূরে একটি প্রামথিক স্কুলের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি। যে যার সান্নিধ্যে বিভোর। এক দম্পত্তিকে গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। জানালেন, এখানে এসেই কোনও এক সরস্বতী পুজোর দিন তাঁদের আলাপ হয়েছিল। প্রেম গড়িয়েছে বিয়েতে। পুরনো দিনের টানে এসেছেন মেলায়।

যাদের ভাগ্যে এখনও প্রেম জোটেনি, তেমন যুবক-যুবতীদেরও চোখে পড়ল। চোখেমুখে আহ্বান কিংবা ধরা দেওয়ার ইচ্ছে ঝলমল করছে।

সব কিছু শেষ হয় বিকেল ৪টেয় এসে। তারপরই বিএসএফের জওয়ানেরা তাড়া দেন জায়গা খালি করার জন্য। এক জওয়ানের কথায়, ‘‘আজকের দিনে সকলের জন্য বর্ডার রোড খুলে দেওয়া হয়। ভালবাসার এমন প্রকাশ দেখে আমাদেরও ভাল লাগে এই দিনটায়।’’ ফেরার পথে বাইকে প্রেমিকাকে নিয়ে হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন সদ্য তরুণটি। দাঁড় করিয়ে কথা বলে জানা গেল, আজই নাকি আলাপ। লাজুক হেসে তরুণী বললেন, ‘‘ভাবছি কালই ওকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দেবো।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন