বাঁ দিক থেকে, সমীর দত্ত ও প্রবোধ সরকার।
আজ বাদে কাল, শনিবার নতুন পুরপ্রধান হিসাবে দলের জয়ী কাউন্সিলরদের মধ্যে থেকে কেউ একজন শপথ নেবেন। অথচ উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগর-কল্যাণগড়ে পুরপ্রধান কে হতে চলেছেন, তা নিয়ে জটিলতা কাটল না এখনও।
পুরসভার ২৩টি আসনের মধ্যে মধ্যে এ বার তৃণমূল পেয়েছে ১৮টি আসন। কিন্তু এমন কুসুমাস্তীর্ণ জয়েও পুরপ্রধান নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হিমসিম খাচ্ছে দল। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্পষ্ট করে কারও নাম জানাতে পারেননি জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের কর্মী-সমর্থক তো বটেই, বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও কৌতুহল তৈরি হয়েছে। চায়ের দোকান, রাস্তা, হাট-বাজারে চলছে জোর তর্ক।
রাজ্যের কিছু পুরসভায় শপথগ্রহণের দিন বন্ধ খামে পুরপ্রধানের নাম এসে পৌঁছেছে দলের তরফে। খাম খোলার পরে প্রত্যাশিত নাম দু’একটি ক্ষেত্রে বদলে গিয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে। স্বাভাবিক ভাবেই অপ্রস্তুত হতে হয়েছে তৃণমূলকে। অশোকনগর-কল্যাণগড়ে কী হতে চলেছে, তা জানতে অপেক্ষা আর কিছু ঘণ্টার।
গতবারও এখানে পুরবোর্ড ছিল তৃণমূলের দখলে। সে বার ২২টি আসনের মধ্যে ২০টিতে জিতে প্রথম বারের জন্য ওই পুরসভার ক্ষমতা দখল করেছিল তৃণমূল। দলীয় ‘হুইপ’ মেনে দলীয় কাউন্সিলরেরা পুরপ্রধান হিসাবে সমীর দত্তকে সমর্থন করেছিলেন। সমীরবাবু পুরপ্রধান হয়েছিলেন। সে বারও পুরপ্রধান হতে গিয়ে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছিল বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা প্রবোধ সরকারের সঙ্গে। প্রবোধবাবুকে গতবার উপ পুরপ্রধানের পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। সমীরবাবু যেহেতু বিদায়ী পুরপ্রধান ও এ বারের জয়ী কাউন্সিলর, স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরই দাবি জোরাল। কিন্তু রাজনীতির হিসাব কখনও অঙ্কের সহজ নিয়ম মেনে চলে না। প্রবোধবাবুও কাউন্সিলর হিসাবে জয়ী হওয়ায় পুরপ্রধান পদের দাবিদার তিনিও।
জেলা তৃণমূল সূত্রের খবর, পুরপ্রধান হিসাবে মূলত এই দু’জনের নামই এখনও দলীয় স্তরে আলোচনা হয়েছে। জেলা তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘সমীরবাবু বা প্রবোধবাবুর মধ্যেই কেউ একজন পুরপ্রধান হচ্ছেন, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। যদি না শেষ মুহূর্তে অত্যাশ্চর্য কিছু ঘটে!’’
পুরপ্রধান নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন দলীয় কাউন্সিলরেরাও। তৃণমূল সূত্রের খবর, ১৮ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ন’জন করে বিভক্ত দু’টি শিবিরে। এবং বিষয়টি নিয়ে বিশেষ রাখঢাকও করছেন না কেউ।
অশোকনগর-কল্যাণগড় পুর এলাকায় বা তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যায়, সমীরবাবু ও প্রবোধবাবুর বিরোধের কথা। দু’জনেরই জনপ্রিয়তা রয়েছে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। আইন-শৃঙ্খলা, নিকাশি, পরিবহণের সমস্যা না মেটায় পুরপ্রধান হিসাবে সমীরবাবুর বিরুদ্ধে কিছু জনমত তৈরি হয়েছে। কিন্তু দু’জনেই পুরপ্রধান পদের জন্য মরিয়া। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গতবারও পুরপ্রধানের পদ নিয়ে সমীরবাবু ও প্রবোধবাবুর মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছিল। সে বার শপথ গ্রহণের দিন বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার দলের ‘হুইপ’ নিয়ে এসে কাউন্সিলরদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে দলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর ছিল। তবে অশোকনগরে এখনও পর্যন্ত দলের পক্ষ থেকে কোনও ‘হুইপ’ এসে পৌঁছয়নি বলে দলীয় সূত্রের খবর। এক কাউন্সিলর জানালেন, ‘‘যত দূর খবর পাচ্ছি, জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি রথীন ঘোষ শনিবার দলের হুইপ নিয়ে আসবেন। দল যা সিদ্ধান্ত জানাবে, আমরা কাউন্সিলরেরা তা মেনে নেব।’’
ভোটের আগে প্রার্থী বাছাই নিয়েও দু’পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মারপিট বেধেছিল। পুলিশ নিয়ে লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। প্রচারেও সমীরবাবু ও প্রবোধবাবুকে বিশেষ বিশেষ ওয়ার্ডে সে ভাবে দেখা যায়নি। ইতিমধ্যেই পুরসভায় দলনেতা নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। তা নিয়েও অবশ্য কাউন্সিলরেরা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেননি। শেষে দলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও অশোকনগরের বিধায়ক ধীমান রায়কে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। শেষমেশ ভোটাভুটি করতে হয়। সেখানে দেখা যায়, দু’পক্ষের দু’জনের সমর্থনেই ৯টি করে ভোট পড়েছে। তখন জ্যোতিপ্রিয়বাবুর নির্দেশে ধীমানবাবু দলনেতা হিসাবে প্রবোধগোষ্ঠীর কাউন্সিলর শ্রীকান্ত চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেন। সে সময়ে সমীরবাবু-সহ তাঁর অনুগামী কাউন্সিলররা সভাকক্ষ ত্যাগ করেছিলেন।
তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বুধবার সন্ধ্যায় সমীরবাবু তাঁর পক্ষের আট জন কাউন্সিলরকে নিয়ে কল্যাণগড় এলাকার দলের প্রাক্তন কাউন্সিলর নান্টুরঞ্জন রায়ের বাড়িতে গোপন বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, পুরপ্রধান হিসাবে তিনি এ বারও শপথ নিচ্ছেন। দলের রাজ্য নেতৃত্ব তাঁকে ওই বিষয়ে সবুজ সংকেত দিয়েছেন। রাজ্য নেতৃত্বের কেউ কেউ জেলা সভাপতিকেও ফোন করে সমীরবাবুকে না সরানোর জন্য বলেছেন বলে সমীরবাবু দাবি করেছেন। যদিও বৈঠকে থাকা কাউন্সিলরেরা সকলেই যে সমীরবাবুর কথা বিশ্বাস করছেন, তা নয়।
অন্য দিকে, প্রবোধবাবু শিবিরের দাবি, সমীরবাবুর সঙ্গে বৈঠকে থাকা কাউন্সিলরদের মধ্যে দু’জন তাঁদের শিবিরে রয়েছেন। প্রবোধবাবু বলেন, ‘‘পুরপ্রধান কে হবেন, তা ঠিক করবে দলীয় নেতৃত্ব। ওই বিষয়ে আমার কোনও মতামত নেই।’’
দলীয় সূত্রের খবর, বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের ‘উদ্যোগে’ গতবার পুর প্রধান হয়েছিলেন সমীরবাবু।ওই সময় জেলা রাজনীতিতে কাকলিদেবীর ‘প্রভাব’ ছিল অনেকটাই বেশি। প্রবোধবাবু এলাকায় তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের খাদ্য মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তাঁর মাথায় আবার বিধায়ক ধীমান রায়ের হাত আছে বলে দলের সূত্রের খবর। যদিও ধীমানবাবুর কথায়, ‘‘পুরপ্রধান কে হবেন, তা জেলা নেতৃত্ব ঠিক করবেন। দল এখনও আমাকে পুরপ্রধানের বিষয়ে কিছু জানায়নি।’’
সমীরবাবু ও প্রবোধবাবুরা নিজেদের মতো করে রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বের কাছে নিজেদের হয়ে দাবি পেশ করছেন। তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, শেষ মুহূর্তে কাকলিদেবীও আসরে নেমেছেন সমীরবাবু সমর্থনে। জেলা রাজনীতিতে ওয়াকিবহল মহল মনে করছে, এ বার পুরপ্রধান নির্বাচন নিয়ে জেলা সভাপতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থাকবে।
সমীরবাবু বলেন, ‘‘আমি দলীয় শৃঙ্খলা মেনে চলি। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ মেনে পাঁচ বছরে এলাকায় পুরসভায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। পুরপ্রধানের বিষয়ে নেত্রী যে সিদ্ধান্ত নেবেন, আমি তা মেনে চলব।’’
জ্যোতিপ্রিয়বাবু গোটা বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। সব মিলিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পুরপ্রধানের পদ নিয়ে জমজমাট নাটক দেখতে চলেছে অশোকনগর-কল্যাণগড়।