অতীত হাতড়ে সুদিন ফেরার অপেক্ষায় ফুটবলের শহর

এক সময়ে এ রাজ্যে ফুটবলার তৈরির অন্যতম প্রধান কারখানা হিসেবে পরিগণিত হত বসিরহাট। এই শহরের আনাচ-কানাচ থেকে একের পর এক ফুটবলার দাপিয়ে খেলেছেন ফুটবলের মক্কা, কলকাতা ময়দানে। রাজ্যের গণ্ডী ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে গিয়েও মুঠো মুঠো সাফল্য কুড়িয়ে এনেছেন এক এক জন।

Advertisement

নির্মল বসু

বসিরহাট শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:৫৯
Share:

চুণী গোস্বামীর সঙ্গে বসিরহাটের ফুটবলপ্রেমীরা।

এক সময়ে এ রাজ্যে ফুটবলার তৈরির অন্যতম প্রধান কারখানা হিসেবে পরিগণিত হত বসিরহাট। এই শহরের আনাচ-কানাচ থেকে একের পর এক ফুটবলার দাপিয়ে খেলেছেন ফুটবলের মক্কা, কলকাতা ময়দানে। রাজ্যের গণ্ডী ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে গিয়েও মুঠো মুঠো সাফল্য কুড়িয়ে এনেছেন এক এক জন।

Advertisement

সেই উজান অবশ্য এখন আর নেই। বসিরহাটের ফুটবলে এখন বরং ভাটার টান।

ফুটবল নিয়ে কী উন্মাদনাই না ছিল শহরটার! এখানকার কারমাইকেল শিল্ডের এ বার শতবর্ষ। গোটা দেশেই এত প্রাচীন ফুটবল প্রতিযোগিতার আসর হাতে গোনা। গত কয়েক দশকে এই শহর কম ফুটবলারের জন্ম দেয়নি। মিহির বসু, বিক্রমজিৎ দেবনাথ, রবীন সেনগুপ্ত (ঘ্যাস দা), দীপেন্দু বিশ্বাস, নীলেশ সরকার, নাসির আহমেদ, হাবিবুর রহমান, নাড়ু গোপাল হাইত, নাজিমুল হক তালিকা বাড়তেই থাকে।

Advertisement

বহু বছর ধরে ফুটবল খেলা পরিচালনার সাথে যুক্ত কালিদাস মজুমদার অতীতে ডুব দেন। বলছিলেন, “মিহির সে বার ইস্টবেঙ্গলে। প্রতিপক্ষ সবুজ-মেরুন। ওর খেলার ধারাবিবরণী শুনতে রেডিও-তে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল গোটা বসিরহাট। জোরাল শটে বাগানের জালে বল জড়িয়ে দিয়েছিল বসিরহাটের ছেলে। ইস্টবেঙ্গল ২-০ গোলে জেতে।” ইতিহাস বলছে, ওই ম্যাচের পরে আর পিছন ফিরে থাকাতে হয়নি মিহিরকে। তিন বড় দলেই দাপিয়ে খেলেন তিনি। দেশ-বিদেশে দাপিয়ে খেলেন। হয়ে ওঠেন বসিরহাটের কিংবদন্তী। দীপেন্দু বিশ্বাস তিন বড় দলে খেলে দু’শোর বেশি গোল করেছেন। জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছেন অলোক দাস। দীপেন্দুও দেশের হয়ে খেলেছেন। তিনি এবং পার্থসারথি দে ভারতীয় সাবজুনিয়ার দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

১৯০৭ সালে বসিরহাটের তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জে এস সোয়ানের উৎসাহেই এখানে ফুটবল প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়। পর পর তিন বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেই রায় হরেন্দ্রচৌধুরী কাপ চিরতরে জিতে নেয় টাকি সরকারি স্কুলের ছেলেরা। বসিরহাট শহরে শুরু হতে চলেছে শতবর্ষে পড়া কারমাইকেল শিল্ড। ক্রীড়া সংগঠক তিলক বসু জানান, তথ্য ঘেঁটে জানা যায় ১৯১২ সালে গঠিত হয়েছিল বসিরহাট ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ)। রুপো দিয়ে তৈরি কারমাইকেল শিল্ড জেতার মারকাটারি লড়াই দেখতে মাঠের ধারে ভিড় ভেঙে পড়ত। প্রথম বার জয়ী হয়েছিল আড়বালিয়া এফসি। দুই বাংলার ফুটবলারেরাই শীল্ডে অংশ নিতেন। আমেদ খাঁ, পিটার থঙ্গরাজ, সুব্রত ভট্টাচার্য-সহ কলকাতার তিন প্রধান সহ বাংলার প্রথম শ্রেণির ক্লাবের বহু ফুটবলার এই প্রতিযোগিতায় খেলে গিয়েছেন।

১৯৮০ সাল থেকে পর পর চার বছর বসিরহাটের ছেলেরা আন্তঃ মহকুমা ফুটবল প্রতিযোগিতায় জেলা চ্যাম্পিয়ান হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। পাশাপাশি রাজ্য স্কুল প্রতিযোগিতাতেও ভালো ফল করে বসিরহাটের স্কুলগুলি। ফুটবলপ্রেমীদের মতে, ওই সময়টাই ছিল বসিরহাটের ফুটবলের স্বর্ণযুগ। ১৯৮৭ সালে কালীনগর স্কুল এবং ১৯৮৮ সালে বসিরহাট হাইস্কুল রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হয়ে গোষ্ঠ পাল ট্রফি জেতে। ১৯৯২ সালে ঢাকা মেয়র একাদশের সাথে বসিরহাট পৌরসভা একাদশের খেলা হয়। বসিরহাট ১-০ গোলে জেতে। বসিরহাট স্টেডিয়ামে খেলে গেছে বাংলাদেশে আবাহনী ক্রীড়াচক্র, এশিয়ান গেমসের জন্য গঠিত ভারতীয় দল। মালয়েশিয়া থেকেও মহিলা ফুটবল দল খেলে গেছে এই শহরে। এক সময়ে ভ্রাতৃসঙ্ঘ, ইয়ংস্টার, প্রান্তিক, টাকি এরিয়ান ক্লাব, মিলন সংঘ, জাতীয় পাঠাগার, টাউন ক্লাব, কিশোর বাহিনী, নেতাজী ইউনিয়ান-সহ বসিরহাটের নানা প্রান্তে ফুটবল প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা ছিল। হ্যামিলটন, লেডি রানু মুখার্জি এবং শচীন মেমোরিয়াল স্মৃতি শীল্ড প্রতিযোগিতার বেশ জনপ্রিয়তা ছিল।

দীপেন্দুর পরে অবশ্য বসিরহাটের কোনও ছেলে জাতীয় স্তরে তেমন নাম করতে পারেনি। ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের বক্তব্য, বর্তমানে ছেলেরা সে ভাবে মাঠে আসছে না। কম্পিউটার বা টিভির অনুষ্ঠানে তারা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। ছেলেমেয়েদের মাঠে পাঠানোর ব্যাপারে অভিভাবকরাও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে ছেলে না পেয়ে অনেক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেক প্রতিযোগিতাও বন্ধ। সমীর বসু, তপন ঘোষ, সমীরণ ব্রহ্ম, সুব্রত ভট্টাচার্য়, ত্রিদিব ব্রহ্মরা অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। সে ভাবে নাম করতে না পারলেও কিছু ছেলে কলকাতা ময়দানে নিয়মিত খেলছেন।

বসিরহাট জুনিয়র ফুটবল কোচিং সেন্টারের প্রশিক্ষক সমীর বসুর পর্যবেক্ষণ, স্কুল স্তরে খেলা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া, ছোট পরিবার, পড়াশোনার চাপ এবং কম্পিউটারের প্রতি অত্যধিক ঝোঁক প্রভৃতি নানা কারণে ফুটবলে ছাত্র কমছে। তার উপর উপযুক্ত মাঠেরও অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, “সরকারি সাহায্যের অভাবে কোচিং ক্যাম্প চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ বসিরহাট স্টেডিয়ামের হাল প্রসঙ্গে মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক প্রবীর বসু বলেন, ‘‘মাঠে নাটক, যাত্রা, মেলা, সভা, বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠান হওয়ার পরে তা খেলার উপযোগী থাকে না। বৃষ্টি হলে জল জমে যায়।” বসিরহাটের ক্রীড়া সংগঠক তিলক বসু, মানস বিশ্বাসের বক্তব্য, ওই মাঠের দু’দিকে গ্যালারি এবং ড্রেসিংরুম জরুরি। দরকার জল নিকাশি ব্যবস্থার ভাল বন্দোবস্ত করা। ফুটবলের উন্নতিতে বিকল্প মাঠের দরকার বলেও মনে করেন তাঁরা। সম্প্রতি দীপেন্দুর চেষ্টায় অ্যাটলেটিকো দ্য কলকাতার কয়েকজন প্রশিক্ষক বসিরহাট এবং টাকিতে এসেছিলেন ভাল ফুটবলারের খোঁজে। তাঁরা আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন, সুন্দরবন এলাকার ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। পরে নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতায়। সেই আশ্বাস কবে বাস্তবায়িত হয়, সেটাই দেখার।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন