জয়ের উল্লাস নবনির্বাচিত সাংসদকে নিয়ে। বাগদায় নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।
জয়ের আনন্দ? এক মুহূর্ত যেন থমকে গেলেন কথাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে। বললেন, “স্বামীর মৃত্যুতে ভোটে দাঁড়াতে হয়েছে। জিতেওছি। কিন্তু স্বামীকে হারানোর কষ্টটাই ফিরে ফিরে আসছে।”
গাইঘাটার ঠাকুরনগরে ঠাকুরবাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল সদ্য ভোটে জয়ী তৃণমূল সাংসদ মমতা ঠাকুরের সঙ্গে। তাঁর স্বামী, সাংসদ কপিলকৃষ্ণের মৃত্যুতেই বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে অকাল ভোট হয়েছে। জিতেওছেন মমতা।
কেমন লাগছে রাজনীতির মঞ্চে প্রথমবার দাঁড়িয়ে এত বড় সাফল্যে?
“ভাল তো লাগবেই। কিন্তু মনে হচ্ছে আরও কিছু কথা”— মমতা বলে চলেন। বলেন, “খুব কষ্ট হয়েছে, যখন আমাকে অশিক্ষিত বলে, বহিরাগত বলে প্রচার শুনেছি। একা একা আড়ালে কেঁদেছি। কিন্তু এ সব সমালোচনায় হয় তো কোথায় ভিতরে ভিতরে একটা জোরও পেয়েছি।” সদ্য নির্বাচিত সাংসদ জানান, প্রথম দিন ভোটে বেরিয়েই বিশ্বাস জন্মেছিল, তিনি জিতবেনই। সেই মতো নিজেকে বোঝান, এ সব কটূ কথায় গুরুত্ব দেবেন না। বরং এ সব কথা তাঁকে আরও শক্তি জোগাবে।
মঙ্গলবার সকালটা একটু যেন অন্য রকম। প্রথম বসন্তের হাওয়া। নীল, স্বচ্ছ্ব আকাশ। এ ক’দিন ঠাকুরবাড়িতে বিস্তর রাজনৈতিক শোরগোলের পরে এ দিন সব শান্ত। আগের সেই মতুয়াদের ধর্মীয় পীঠস্থানের পরিবেশ যেন ফিরে এল বহু দিন বাদে। সে কথা জানালেন সকাল থেকে ঠাকুরবাড়িতে ভিড় করা অনেক মতুয়া ভক্তই। বেলা ১০টা নাগাদ মমতার দেখা পেলেন তাঁরা। সদ্য স্নান সেরে এসেছেন। কথাবার্তায় ধীর-স্থির। হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে পুজো দিলেন মমতা। ভক্তদের প্রসাদী কাঁচাগোল্লা দিলেন হাতে হাতে। মাথায় ঠেকিয়ে খেতে খেতে এক মহিলা ভক্তকে বলতে শোনা গেল, “আজ এই প্রসাদ তো অমৃত মনে হচ্ছে। এত ভাল যেন আগে কখনও লাগেনি।” পাশ থেকে হেসে বললেন আর এক জন, “এখন থেকে মতুয়া বাড়ির সবই ভাল লাগবে।”
ভক্তদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মমতা কখনও উঠে যাচ্ছিলেন ঘরের ভিতরে। সেখানে ছোট মেয়ে চন্দ্রলেখার ব্যাগপত্র গোছগাছ চলছে। মা ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন বলে কথা। ভিনরাজ্য থেকে পড়াশোনার ফাঁকে মেয়ে চলে এসেছিলেন মায়ের কাছে। ভোটের ফল বেরনোর পরে এ বার ফেরার তাড়া। এ দিন বাড়িতে যত রাজ্যের খবরের কাগজ এসেছে। সে সবই উল্টে পাল্টে দেখছিলেন তরুণী চন্দ্রলেখা। বাংলা পড়তে পারেন না। তবে মায়ের ছবি, কখনও মায়ের পাশে নিজের ছবি দেখে খুশি। বলতে শোনা গেল, “আমি তো এমপি-র মেয়ে!” বস্তুত, বাবা প্রয়াত সাংসদ, মা বর্তমান সাংসদ— এমন সৌভাগ্য ক’জন সন্তানের কপালে হয়!
ঘরের মধ্যে মেয়ের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে চিরন্তন বাংলার বধূ রূপে মমতা। মেয়ে সব জিনিস ঠিকঠাক নিয়েছে কিনা, বার বার জিজ্ঞেস করছেন। আবার দরজার বাইরে বেরিয়েই ভক্তদের নানা আবদারের জবাব দিতে হচ্ছে। কেউ বলছেন, “মা, ছেলেটা অসুস্থ। অনেক দিন হল, সারছে না। ওকে আশীর্বাদ করো।” মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করছেন মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি মমতা। আবার তক্ষুণি হয় তো এসে পড়ছে রাজনীতির প্রসঙ্গ। “মা, আমাদের গ্রামে জলের কলটা কিন্তু মনে রেখো।” “রাখব, রাখব”— জবাব মিলছে। কাউকেই ফেরাচ্ছেন না সদ্য নির্বাচিত সাংসদ। ভোটে দাঁড়িয়ে এত লোকজন, হইচই, ভিড়ভাট্টা, আরও নানা ঝক্কি সামলালেন কী করে? প্রশ্ন শুনে একটু হেসে মমতা বলেন, “আমাদের মহারাষ্ট্রের বাড়িতেও অনেক মতুয়া ভক্ত যাতায়াত করতেন। ছোট বেলা থেকে সে সব দেখেই বড় হয়েছি। এ বাড়ির বৌ হয়ে যখন এলাম, তখনও অনেক ভক্তের সঙ্গে মেলামেশা হয়েছে। ফলে এ সব আমার কাছে নতুন নয়।” নতুন যেটা, তা হল ব্যক্তিগত আক্রমণ, নিন্দা হজম করা। বার বারই সাংসদের কথায় উঠে এল সেই প্রসঙ্গ। মমতা জানালেন, ২৩ তারিখ দিল্লি যাওয়ার কথা। তার আগে দেখা করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কী হবে সাংসদের ভূমিকা? মমতা বলেন, “অনেক দায়িত্ব। তবে যাই করি, ঠাকুরবাড়ির সম্মান এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।”
এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোন মমতা ঠাকুর। বনগাঁর ছয়ঘরিয়া এ দিন এক বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধির বাড়িতে আসেন মমতা। ঠাকুরনগরে বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র প্রচারের দিন দুর্ঘটনায় জখম হয়েছিলে ওই প্রতিনিধি। এরপরে বাগদার বৈকলায় যান মমতা। বার্ষিক মতুয়া মহাসম্মেলন ও মেলায় সকলের সঙ্গে ভক্তদের করেন। রাস্তায় হাজার হাজার মতুয়া ভক্ত ভিড় করেছিলেন তাঁকে দেখতে। গাড়ি থেকে নামতেই শুরু হয় নাচ। ফুল ছিটিয়ে বরণ করা হয় সদ্য নির্বাচিত সাংসদকে। হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে যান মমতা। মঞ্চে ‘মতুয়া জননী’ সম্বোধন করে মমতাকে শাড়ি উপহার দেন উদ্যোক্তারা। মহিলাদের মধ্যে আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো।
এরপরে নদিয়ার বগুলায় যান মমতা। ক’দিন আগে এক মতুয়া ভক্ত মারা গিয়েছিলেন এই এলাাকায়। সেখানে দেখা করেন মমতা। সন্ধে ৭টা নাগাদ ফেরেন ঠাকুরনগরের বাড়িতে। সামান্য বিশ্রামের পরেই রওনা দেন কলকাতার দিকে।