গেটের বালাই নেই, লেভেল ক্রসিং যেন মরণফাঁদ

কোথাও নিরাপত্তারক্ষী নেই, তো কোথাও গেটই নেই। এমন ভাবেই দিনের পর দিন মানুষ পারাপার করছেন রেললাইন। আর তাতেই ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দিনের পর দিন। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের কোনও হেলদোল নেই বলে অভিযোগ। পূর্ব রেলওয়ের শিয়ালদহ-নামখানা শাখায় এই রকম অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে লেভেল ক্রসিং থাকলেও গেটম্যান নেই।

Advertisement

দিলীপ নস্কর

কাকদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৪৭
Share:

কাকদ্বীপের কামারহাটের বামুনেরচকে লেভেল ক্রসিংয়ে এ ভাবেই ঝুঁকি নিয়ে চলে পারাপার। নিজস্ব চিত্র।

কোথাও নিরাপত্তারক্ষী নেই, তো কোথাও গেটই নেই। এমন ভাবেই দিনের পর দিন মানুষ পারাপার করছেন রেললাইন। আর তাতেই ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দিনের পর দিন। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের কোনও হেলদোল নেই বলে অভিযোগ।

Advertisement

পূর্ব রেলওয়ের শিয়ালদহ-নামখানা শাখায় এই রকম অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে লেভেল ক্রসিং থাকলেও গেটম্যান নেই। কিংবা লেভেল ক্রসিংটাই নেই। রাস্তার বুক চিরে গিয়েছে অরক্ষিত লাইন। সেখানেই পারাপার করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে প্রায়শই। ক’দিন আগে ডায়মন্ড হারবারের কুলপি থানার সিংহেরহাটে এ রকমই একটি ‘ক্রসিংয়ে’ ট্রেনের ধাক্কায় গাড়ির চালক সহ কয়েক জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। পরে কয়েক ঘণ্টা অবরোধও করেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। কিন্তু তারপরেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি রেল কর্তৃপক্ষ।

অথচ রেল বোর্ড এ বছর নতুন একটি বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট করে কিছু নির্দেশিকা জারি করেছে। ওই নির্দেশিকায় বোর্ড বলেছে, প্রথমে লেভেল ক্রসিং করার কথা না ভেবে সেখানে ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস করার কথা খতিয়ে দেখতে হবে। যদি এই দু’টি না করা যায়, তবে ওই লাইনের উপর দিয়ে কত গাড়ি যাচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করে সেখানে লেভেল ক্রসিং তৈরি করে প্রহরী রাখতে হবে। আর যেখানে স্কুল পড়ুয়ার গাড়ি রয়েছে সেখানে প্রহরী দেওয়া লেভেল ক্রসিং রাখতেই হবে। এ ছাড়া বলা হয়েছে, লেভেল ক্রসিং নেই এই রকম দু’তিনটি রাস্তা বন্ধ করে একটি রাস্তা খুলে দিয়ে সেখানে ক্রসিং বসানো যেতে পারে। প্রয়োজনে রাখা যেতে পারে ‘গেট মিত্র’। রেলের নিয়মে গেট মিত্র হচ্ছেন এক জন কর্মী, যিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই ক্রসিংয়ে থাকবেন। ট্রেন আসলে মানুষকে সচেতন করবেন।

Advertisement

দুর্ঘটনার পরে সিংহেরহাটে ওই ক্রসিংটিতে ওই রকমই এক গেট মিত্রের দেখা মিলেছে রবিবার। দুপুরের খটখটে রোদ থেকে বাঁচতে গেরুয়া জামা গায়ে ওই যুবক বাবলা গাছের ছায়ায় বসে ছিলেন। অফিসের কাগজপত্র ভরা ব্যাগ ঝোলানো গাছের ডালে। ছবি তুলতে গেলে যুবক রে রে করে তেড়ে এলেন। সব কিছু শোনার পর শান্ত হয়ে জানালেন, সিংহেরহাট লেভেল ক্রসিংয়ের দুর্ঘটনার পরে এখানে তাঁকে নিরাপত্তার দায়িত্বে পাঠানো হয়েছে। ট্রেন এলে তিনিই মানুষকে সচেতন করবেন।

রেল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শিয়ালদহ-নামখানা শাখায় লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশন পর্যন্ত বহু বছর আগেই ট্রেন চলাচল শুরু হয়। তার পর প্রায় ২০ বছর ধরে লক্ষ্মীকান্তপুর-কুলপি, কুলপি-কাকদ্বীপ এবং কাকদ্বীপ থেকে নামখানা পর্যন্ত ধাপে ধাপে লাইন সম্প্রসারণ হয়। লক্ষ্মীকান্তপুরের পরে উদয়রামপুর, করঞ্জলি, নিশ্চিন্তপুর, নিশ্চিন্দিপুর, মাধবনগর, কাশীনগর, কাকদ্বীপ, উকিলেরহাট এবং নামখানা স্টেশন। স্থানীয় কিছু পঞ্চায়েতের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরাও সমস্যাটি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কয়েকটি পঞ্চায়েতের তরফে বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে এর আগে আবেদনও জানানো হয়েছিল।

লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত প্রায় ৪৭ কিলোমিটার রেলপথ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এলাকাবাসীর দাবি, রেলপথ-সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রাম থেকে ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক বা স্টেশন সংযোগকারী রাস্তায় পৌঁছতে গেলে লাইন পেরিয়ে রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। এ দিকে, রাস্তার উপরে অধিকাংশ ক্রসিংয়েই কোনও নিরাপত্তারক্ষী নেই। ওই এলাকায় বিভিন্ন গ্রাম থেকে জাতীয় সড়কে বা স্টেশনে যাতায়াতের রাস্তার উপর দিয়ে রেললাইন গিয়েছে প্রায় প্রায় ৪৪টি জায়গায়। তার মধ্যে রক্ষী ও গেট রয়েছে মাত্র ১১টিতে। সংযোগকারী রাস্তাগুলিতে কোথাও ইট পাতা। কোথাও ঢালাই বা পিচ রাস্তা দিয়ে শ’য়ে শ’য়ে মোটর ভ্যান, সাইকেল ভ্যান, অটো ছাড়াও ছোট বড় গাড়িতে যাত্রী পারাপার চলে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গাড়ি চললেও কোনও লেভেল ক্রসিংয়েই আলোর ব্যবস্থাটুকুও নেই।

ওএনজিসি মোড় থেকে ১৩ নম্বর মোড় পর্যন্ত পিচ রাস্তার মাঝ বরাবর গিয়েছে কাকদ্বীপ থানার কামারহাটের বামুনেরচক লেভেল ক্রসিং। প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই রাস্তায় ক্রসিং পার করে দৈনিক প্রায় ৩০০ মোটর ভ্যান, সাইকেল ভ্যান, অটো-সহ আরও শ’খানেক গাড়ি যাতায়াত করে। আর পার হতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। এক মোটরভ্যান চালক কিরণ হালদার বলেন, “ওই লেভেল ক্রসিংয়ে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, লেভেল ক্রসিংয়ে বেশির ভাগ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মোটরভ্যানগুলি। কারণ লাইনের দু’ধারের রাস্তায় অনেকটা ঢাল। বহন ক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী নেওয়ার জন্য ওই গাড়ি বন্ধ হয়ে এই ঘটনা ঘটে। আবার কাকদ্বীপের কালনাগিনী খালের উপর দিয়ে নামখানার দিকে রেল লাইন গিয়েছে। “প্রায় ৫০ মিটার লম্বা ওই খালের উপরের লাইন পেরিয়ে যাতায়াত করতে গিয়ে এ পর্যন্ত অনেকেরই ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে” এমনটাই দাবি ওই এলাকার বাসিন্দাদের।

রেল কর্তাদের বক্তব্য, চিহ্নিত বেশ কিছু লেভেল ক্রসিংয়ে কর্মীর অভাবে এখনও গেট বসানো যায়নি। গেট তৈরি করে নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগের চেষ্টা চলছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার জন্য মানুষ নিজেরাই দায়ী। নিষেধ না মেনেই লাইন পারাপার করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন