গণধর্ষণ নিয়ে ফের সালিশি পঞ্চায়েত অফিসে

ফের গণধর্ষণের ‘মীমাংসা’ করতে সালিশি সভা আয়োজনের অভিযোগ উঠল তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যের বিরুদ্ধে। বাগদার সিন্দ্রাণী গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান কালীপদ মণ্ডল ধর্ষিতা তরুণী, অভিযুক্ত যুবক ও তাদের পরিবারকে একাধিক বার সালিশিতে ডেকেছেন বলে অভিযোগ। সালিশি হয়েছে পঞ্চায়েত অফিসে।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৪ ০৩:০০
Share:

ফের গণধর্ষণের ‘মীমাংসা’ করতে সালিশি সভা আয়োজনের অভিযোগ উঠল তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যের বিরুদ্ধে। বাগদার সিন্দ্রাণী গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান কালীপদ মণ্ডল ধর্ষিতা তরুণী, অভিযুক্ত যুবক ও তাদের পরিবারকে একাধিক বার সালিশিতে ডেকেছেন বলে অভিযোগ। সালিশি হয়েছে পঞ্চায়েত অফিসে। তাঁরা থানায় যেতে চাইলে তৃণমূল নেতারা বাধা দেন, দাবি ওই তরুণীর পরিবারের। ঘটনার সাত দিন পর, বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশের কাছে গণধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেন ওই তরুণী।

Advertisement

ততক্ষণে চম্পট দিয়েছে মূল অভিযুক্ত অনুপ রায়, ওরফে অমিত। তরুণী বনগাঁ হাসপাতালে ভর্তি। শুক্রবার বনগাঁ মহকুমা আদালতের বিচারক তাঁর গোপন জবানবন্দি নেন। এ দিন মেয়েটির মেডিক্যাল পরীক্ষাও হয়েছে। পুলিশসূত্রে জানা গিয়েছে, লিখিত অভিযোগে গণধর্ষণের কথা লিখেছেন তরুণী। সালিশির অভিযোগ তিনি মৌখিক ভাবে জানিয়েছেন। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “গণধর্ষণের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তে আরও কিছু বিষয় উঠে এলে, তা-ও দেখা হবে।” চার অভিযুক্তের কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।

পুলিশকে ওই তরুণী জানিয়েছেন, ২৭ তারিখ দুপুরে বাগদা থেকে বনগাঁয় মামাবাড়িতে যাচ্ছিলেন। গাঁড়াপোতা বাজার থেকে তাঁকে গাড়িতে অপহরণ করে চার যুবক। তার মধ্যে অমিত তাঁর পূর্বপরিচিত। ওই তরুণীকে মাঝেমাঝেই মোবাইলে উত্যক্ত করত অমিত। নাকে ঝাঁঝাল কিছু ধরে অজ্ঞান করে গাড়িতে তুলে দড়ি দিয়ে তরুণীর হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয়। বেশ খানিকটা দূরে নির্জন জায়গায় তাঁকে নামিয়ে সকলে ধর্ষণ করে। বিধ্বস্ত অবস্থায় ওই তরুণীকে উত্তর ২৪ পরগনা-লাগোয়া নদিয়া জেলার দুবড়া পঞ্চায়েতের বিষ্ণুপুর বাজারে পাওয়া যায়। খবর পেয়ে পরিবার গিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে আসে।

Advertisement

উপপ্রধান কালীপদ মণ্ডল অবশ্য ধর্ষণের ফয়সালার জন্য সালিশির মধ্যে অন্যায় বা বেআইনি কিছু দেখছেন না। তিনি বলেন, “গ্রামের লোকজনকে ডেকে বিষয়টি মিটিয়ে নিতে বলেছিলাম মেয়ের পরিবারকে। এর বেশি কিছু নয়।” তরুণীর পরিবার দাবি করেছে, সালিশিতে হাজির ছিলেন কালীপদবাবু স্বয়ং। সালিশি হয়েছে অন্তত তিন বার। মূল অভিযুক্ত অমিতের বাবা নিখিলরঞ্জন রায়ও বলেন, “বিষয়টি মিটমাটের জন্য কালীপদবাবু আমাদের পঞ্চায়েত অফিসে ডেকেছিলেন। কয়েক বার আলোচনা হয়েছে।”

ঘটনাটিকে লঘু করে দেখছে না তৃণমূল নেতৃত্ব। জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জানিয়েছেন, বনগাঁ (উত্তর) বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস ও বনগাঁরই প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠকে নিয়ে দলীয় স্তরে তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে। তিনি বলেন, “তদন্তে যদি দেখা যায় সালিশি বসিয়েছিলেন ওই উপপ্রধান, তা হলে তাঁকে দল থেকে বরখাস্ত করা হবে।” তিনি জানান, পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না। সিন্দ্রাণী পঞ্চায়েতের মহিলা প্রধান নীতা বালা অবশ্য বলেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।

এর আগে বীরভূমের লাভপুরে এক আদিবাসী তরুণীর গণধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রেও সালিশি সভার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য অজয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে। অজয়বাবু তখন সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেছিলেন, তিনি সালিশি ডাকেননি, উপস্থিত ছিলেন শুধু। কিন্তু গণধর্ষণ নিয়ে সালিশিতে উপস্থিত থাকার জন্য দল কী ব্যবস্থা নিয়েছে অজয়বাবুর বিরুদ্ধে? শুক্রবার এ প্রশ্ন করা হলে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বলেন, “খোঁজ নিয়ে দেখেছি, অজয়বাবু ওখানে ছিলেন না। ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।”

তৃণমূলের এই অবস্থান ব্যতিক্রমী নয়। পার্ক স্ট্রিট বা কাটোয়ার গণধর্ষণকে লঘু করার চেষ্টা, সাংসদ তাপস পালের ‘রেপ করিয়ে দেব’ মন্তব্যকে মুখ্যমন্ত্রীর ‘ছোট্ট ঘটনা’ বলা, এগুলির প্রেক্ষিতে বাগদার অভিযোগের পরে বরং তৃণমূলের এই তৎপরতা তাৎপযপূর্ণ। তবে বাগদার ঘটনায় কেবল কালীপদ মণ্ডল নয়, উঠে এসেছে আরও দুই তৃণমূল নেতার নাম, যাঁরা গণধর্ষণের অভিযোগ জেনেও পুলিশে খবর দেননি।

তরুণীর বাবার বক্তব্য, সালিশিতে দোষ স্বীকার করেনি অমিত বা তার পরিবার। তিনি বলেন, “বুধবার আমরা বাগদা থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু অঘোর (হালদার)-সহ কয়েক জন স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মী আমাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে থানা থেকে নিয়ে আসে। আমরাও জেদ ধরি, পুলিশের কাছে অভিযোগ করবই।” অঘোরবাবুর অবশ্য দাবি, “লোকমুখে ঘটনাটা শুনেছি। পরিবারটিকে চিনিই না। বাধা দেওয়ার প্রশ্ন নেই।”

তৃতীয় যে তৃণমূল নেতার নাম উঠে আসছে, তিনি নদিয়ার দুবড়া পঞ্চায়েতের বিষ্ণুপুর এলাকার কমল মল্লিক। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২৭ জুন বিকেল ৫টা নাগাদ বিষ্ণুপুর বাজারে একটি দোকানের সামনে বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় ওই তরুণীকে। দোকানের মালিক অর্চনাদেবী এবং তাঁর স্বামী মেয়েটিকে ওই অবস্থায় দেখে খবর দেন কমলবাবুকে। মেয়েটির পরিচয় জানার পরে কমলবাবু মোবাইলে যোগাযোগ করেন কালীপদবাবুর সঙ্গে। রাজনৈতিক সূত্রে তাঁরা পূর্ব পরিচিত। কালীপদবাবুর মধ্যস্থতায় ওই রাতেই মেয়েটির বাড়ির লোকজন ফেরত নিয়ে যায় তাঁকে।

কিন্তু পুলিশকে কেন খবর দিলেন না কমলবাবুরা? তিনি জানান, মৌখিক ভাবে বিষয়টি জানিয়েছিলেন নিকটবর্তী গাংনাপুর থানায়। সেখান থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়, বনগাঁ বা বাগদা থানার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী যে কোনও থানাই ধর্ষণের অভিযোগ নিতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে তা হয়নি কেন? নদিয়া জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, গাংনাপুর থানায় এমন কোনও অভিযোগই আসেনি। এলাকার রাজনৈতিক নেতা হয়ে কেন ধর্ষণের ঘটনাটি পুলিশে নথিভূক্ত করালেন না কমলবাবু, কেন তৃণমূল নেতারা প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার প্রায় সমান্তরাল একটি দলীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলছেন, সে প্রশ্ন উঠে গেল।

ওই বধূ ও তাঁর পরিবারের লোকজনের অভিযোগ, এলাকায় ফেরার পরে কালীপদবাবু তাঁদের পুলিশের কাছে যেতে নিষেধ করেন। বলেন, দু’পক্ষকে নিয়ে বসে মিটমাট করে ফেলা হবে। শুক্রবার মেয়েটির মা ও বাবা বলেন, “আমাদের অন্তত তিন বার পঞ্চায়েত অফিসে ডেকে পাঠান কালীপদবাবু। সেখানে অভিযুক্ত অমিত ও তার পরিবারও হাজির ছিল।”

শুক্রবার বনগাঁ হাসপাতালে শুয়ে ওই বধূ জানান, হামলাকারী চার জনের মধ্যে একমাত্র অমিতকেই চেনেন তিনি। তবে দেখলে বাকিদের শনাক্ত করতে পারবেন। তরুণী বধূটির কথায়, “আমাদের পুলিশের কাছে কেন যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছিল জানি না। কিন্তু আমরা আইনের মাধ্যমেই দোষীদের শাস্তি চাই।” অভিযুক্ত অমিতের বাবা নিখিলরঞ্জনবাবুর বক্তব্য, “আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় চেয়েছিলাম আমার ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য। কিন্তু তার আগেই থানা-পুলিশ হয়ে গেল।”

তথ্য সহায়তা: সৌমিত্র শিকদার, চাকদহ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন