কাকদ্বীপ

পর্যটনে মানুষের ঢল, শহরের চাহিদা মেটে কই

সালটা ১৯৪৬। জমিদারের খাজনার হাত থেকে বাঁচতে সংগঠিত তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম জন্মভূমি ছিল অবিভক্ত ২৪ পরগনা জেলার কাকদ্বীপ। এই শহরের বাতাসে আজও ভেসে বেড়ায় তেভাগার শহিদ অহল্যা, বাতাসিদের কথা। ধীরে ধীরে ভোল বদলে গিয়েছে শহরের। বহু পর্যটকের আনাগোনা বেড়েছে। কাকদ্বীপ শহর ছুঁয়েই তাঁদের যেতে হয় এখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে।

Advertisement

দিলীপ নস্কর

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ ০০:৫৮
Share:

অবসর বিনোদনের ঠিকানা মনোরম নিউ বকখালি।

সালটা ১৯৪৬। জমিদারের খাজনার হাত থেকে বাঁচতে সংগঠিত তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম জন্মভূমি ছিল অবিভক্ত ২৪ পরগনা জেলার কাকদ্বীপ। এই শহরের বাতাসে আজও ভেসে বেড়ায় তেভাগার শহিদ অহল্যা, বাতাসিদের কথা। ধীরে ধীরে ভোল বদলে গিয়েছে শহরের। বহু পর্যটকের আনাগোনা বেড়েছে। কাকদ্বীপ শহর ছুঁয়েই তাঁদের যেতে হয় এখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শহরের সামগ্রিক পরিকাঠামো নিয়ে বাসিন্দাদের অভিযোগ বিস্তর। শহর কাকদ্বীপের মূল অর্থনীতি এখনও মাছ আর পানের ব্যবসার উপরেই দাঁড়িয়ে।

Advertisement

খেয়াবতী, মুড়িগঙ্গা, কালনাগিনী ও হুগলি নদী ঘেরা কাকদ্বীপ শহর। নদী-জঙ্গলে ভরা এই এলাকা ক্রমশ ঘন জনবসতিতে পরিণত হয়েছে। তবে এই জনবসতির প্রায় অর্ধেকই ও পার বাংলার মানুষ। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে এ পারে এসে তাঁরা কাকদ্বীপে বসত গড়েন।

তবে পরিস্থিতি চিরকাল এক রকম ছিল না। জমিদারি আমলে চাষের ফসলের ৭৫ ভাগ পেতেন জমিদার, বাকি ২৫ ভাগ প্রজা অর্থাৎ চাষিরা। তা ছাড়াও ছিল নানা অছিলায় জমিদারদের ফসলের উপরে খাজনা আদায়। তার মধ্যে ছিল খামার চাচানি (চাষের ফসল যেখানে তোলা হত), কাক তাড়ানি (খামারে তোলা ফসল যাতে কাকে না খায় তার জন্য পাহারা দেওয়া) ইত্যাদি। তা ছাড়া, জমিদার বাড়ির উৎসব অনুষ্ঠানেও প্রজাদের খাজনা দিতে হত। এই অত্যাচার মেনে নিতে না পেরে তাঁরা তেভাগা আন্দোলন শুরু করেন। তাঁরা দাবি করেন ফসলের তিনভাগ তাঁদের দিতে হবে, জমিদার পাবেন এক ভাগ।

Advertisement

সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বুধাখালি গ্রামে পুলিশের গুলিতে মারা যান ৮ জন। তাঁদের এই বলিদানের কথা সাহিত্যের বহু পাতায় লেখা রয়েছে।

সেই শহরটাও বদলেছে অনেক।

বেহাল এই ইটের পথ দিয়েই নিউ বকখালি যেতে বাধ্য হন পর্যটকেরা

কাকদ্বীপ থেকে ডায়মন্ড হারবার বা কলকাতা পর্যন্ত কোনও রাস্তাঘাট ছিল না একটা সময়ে। এক ফালি মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে ডায়মন্ড হারবারে বা কলকাতায় পৌঁছতে হত। হেঁটে কলকাতায় পৌঁছতে দিন দু’য়েক সময় লেগে যেত। সঙ্গে চিঁড়ে-মুড়ি-গুড় নিয়ে বেরোতে হত। রাতে থাকার জায়গা ছিল কালীঘাট এলাকায়। যাদের আর্থিক সঙ্গতি ছিল তাঁরা অবশ্য কাকদ্বীপে স্টিমারঘাট থেকে স্টিমারে করেই কলকাতায় যাতায়াত করতেন।

ইদানীং পর্যটকদের জন্য দেখার মতো মৎস্যবন্দর ছাড়াও বুধাখালি গ্রামের পাশে মুড়িগঙ্গা নদী-লাগোয়া নতুন পর্যটন কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘নিউ বকখালি পর্যটন কেন্দ্র’। নদী-লাগোয়া সৈকত চার দিক দিয়ে সবুজ জঙ্গলে ঘেরা। শীতের মরসুম ছাড়াও সারা বছর পিকনিক-প্রিয় মানুষের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্রটি। সেখানে যেতে হলে কাকদ্বীপ-নামখানা রুটের বাস বা গাড়িতে বিশালাক্ষীপুর মোড়ে নেমে ডান দিক ধরে সোজা রাস্তা। তবে সেই রাস্তা বেহাল। বহু বছর আগে তৈরি প্রায় ৩ কিলোমিটার ইট পাতা রাস্তাটি দীর্ঘ দিন সংস্কার না হওয়ায় গোটা পথটিই এবড়ো-খেবড়ো। চার চাকার ছোট গাড়ি নিয়ে পিকনিক স্পটে যেতে গেলে সমস্যায় পড়তে হয় পর্যটকদের। তবে রাস্তা সংস্কারের জন্য টাকা বরাদ্দ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা।

কাকদ্বীপের অদূরে সাগরে রয়েছে কপিলমুনির মন্দির। প্রায় সারা বছর ধরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য থেকে সেখানে লোক সমাগম লেগেই থাকে। আগে ভিন রাজ্যের পর্যটকেরা হাওড়া থেকে বাসে করে যাতায়াত করতেন। এখন অনেকেই শিয়ালদহ থেকে নামখানাগামী ট্রেনে চেপে কাকদ্বীপ স্টেশন থেকে বা নামখানা স্টেশনে নেমে, সেখান থেকে কপিলমুনির মন্দির দর্শনে যাচ্ছেন। কাকদ্বীপ স্টেশন থেকে বাসে বা মোটর ভ্যানে করে লট-৮ জেটিঘাটে পৌঁছতে হয়। পরে ভেসেলে মুড়িগঙ্গা নদী পার করে সাগরের কচুবেড়িয়া ঘাট থেকে বাসে বা গাড়িতে করে গিয়ে পৌঁছনো যায় কপিলমুনির মন্দিরে।

এ ছাড়াও, কাকদ্বীপ শহর হয়ে যাওয়া যায় বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ। পাশেই রয়েছে হেনরিজ আইল্যান্ড। বকখালি বা ফ্রেজারগঞ্জ জুড়ে রয়েছে বিশাল সমুদ্র সৈকত। আর পাশেই পর্যটকদের জন্য তৈরি বন দফতরের কুমির ও হরিণের বিচরণ ক্ষেত্র। আবার ঝাউ, শাল, সেগুন জঙ্গলে ঘেরা নির্জন হেনরিজ আইল্যান্ড। পর্যটদের থাকার জন্য সেখানে তৈরি হয়েছে সরকারি-বেসরকারি হোটেল, কটেজ। বকখালির এই মনোহর পরিবেশে অনেক বাংলা ও হিন্দি সিনেমার শু্যটিংও হয়েছে।

কলকাতা থেকে দূরত্ব বেশি না হওয়ায় পর্যটকদের ভিড় সারা বছরই লেগে থাকে। শীতের মরসুমে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে তাঁরা ম্যাটাডর, বাস ভাড়া করে চলে আসেন এখানে। কয়েক বছর ধরে শিয়ালদহ-নামখানা ট্রেন চালু হওয়ায় সরাসরি নামখানায় নেমে হাতানিয়া-দোহানিয়া পার হয়ে অনেকেই দল বেঁধে বেড়াতে আসছেন। বকখালি থেকে ট্রলারে বা লঞ্চে করে যাওয়া যায় বিচ্ছিন্ন একটি ছোট দ্বীপ জম্বুদ্বীপে। এক সময়ে মৎস্যজীবীরা মাছ শুকনোর কাজ করতেন। বর্তমানে মৎস্যজীবীদের দ্বীপে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বন দফতর। চারিদিকে সমুদ্র ও নদী ঘেরা ওই দ্বীপে যেতে বন দফতরের অনুমতি প্রয়োজন।

ঝকঝকে এই পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে পৌঁছে যাওয়ার সময়ে কাকদ্বীপ ছুঁয়ে যেতে হলেও শহর কাকদ্বীপ সমস্যায় জর্জরিত। রাস্তা, নিকাশি, স্বাস্থ্য সব কিছু নিয়েই শহরের বাসিন্দাদের নানা অভিযোগ রয়েছে।

(চলবে)

কেমন লাগছে আমার শহর?
আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-কাকদ্বীপ’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন