শহরের নামেই যখন হাট, তখন তার প্রাণকেন্দ্রে তো থাকবেই বিকিকিনি। নীল, নুন দিয়ে যার শুরু, আজ সেখানে হাটের ব্যবসার প্রধান উপাদান সব্জি। ভেড়ির মাছ, ভাটার ইট এখন প্রধান পণ্য বসিরহাটের। শহরে টাকার রমরমা বেড়েছে। বেড়েছে জমির দাম, হচ্ছে নতুন নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি। তবু ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে তার অবস্থানের মতোই, অর্থনীতিতেও বসিরহাট যেন রয়ে গিয়েছে সীমান্তে। সমৃদ্ধি আর অপরাধ, দুটো যেন চলছে পাশাপাশি।
বসিরহাট পুরসভা। সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।
বসিরহাট পুরসভার ওয়েবসাইটের দাবি, এখানে যে বাণিজ্য হত তা ছিল করমুক্ত, স্বাধীন। এখনকার ‘ফ্রি ট্রেডিং সেন্টার’-এর মতো। ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরুটা হয়েছিল নুন দিয়ে। স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে যতটুকু জানা যায়, তাতে মহকুমা গঠনের সময়ে প্রশাসনিক কাজের জায়গা ছিল ইছামতী নদীর তীরে বর্তমানে সোলাদানার বাগুন্ডি গ্রাম। ওই বাগুন্ডিকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লবণ ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে বেছে নিয়ে সেখানে ‘সল্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট’ অফিস করে। ইছামতীর লবণাক্ত জল থেকে নুন তৈরি হত। সে কারণে ইংরেজ আমলে বসিরহাটের বিভিন্ন গ্রামে ইছামতী নদীর ধারে নুনের গোলা তৈরি করা হয়। বসিরহাট শহরে ছিল নুনের বাণিজ্য কেন্দ্র। ১৮২২ সালে সেখানকার ‘নিমকি দেওয়ান’ বা সেরেস্তাদার হয়েছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। কলকাতার বরাহনগর ঘাট থেকে ইছামতী নদী পথে বাগুন্ডিতে আসতেন দ্বারকানাথ। টাকির জমিদার মুন্সি কালীনাথ রায়চৌধুরী আতিথ্যে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হত।
ব্যবসার আর এক পণ্য ছিল নীল। ১৮১০ সালে নীল চাষ শুরু হয় বসিরহাটে। ইছামতীর দু’ধার ঘেঁসে স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়া, মালঙ্গপাড়া, চারঘাট, বাদুড়িয়ার মেদে, খোড়গাছি, আটুরিয়া, পুঁড়া, বসিরহাটের ধলতিথা, দন্ডিরহাট, ইটিন্ডা এবং নৈহাটিতে গড়ে ওঠে নীলকুঠি। কালীনাথের চেষ্টায় এক দিকে যখন টাকিতে শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটছে, সে সময়েই ইংরেজরা বাগুন্ডিকে কেন্দ্র করে নুন ও নীল চাষের ব্যবসা চালাচ্ছে। নদিয়ার মাজদিয়া থেকে বেরিয়ে সুন্দরবনের রায়মঙ্গলে মিশেছে ইছামতী। তার ধার ঘেঁসে শুরু হয় হাট-বাজার। ১৮৪০ সালে ইছামতীর ধারে হাট এবং তারও ৬০ বছর পরে ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বসিরহাটের পুরাতন বাজার। বসিরহাটের নতুন বাজার স্থাপিত হয় ১৯২২ সালে।
বসিরহাট কাদের হাট? বসুদের না বশির খানের? নাকি বাঁশের হাট থেকে বসিরহাট? বসুরহাট, বোসেরহাট, বাঁশেরহাট, বস্তিরহাট, বহুরহাট, বশিরহাট এক এক ইতিহাসবিদের খোঁজে উঠে এসেছে বসিরহাটের নামের নানা উৎস। বর্তমানে উত্তর ২৪ পরগনা সুন্দরবন-সংলগ্ন বসিরহাট মহকুমার নাম নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে নদীর ধারে প্রাচীন একটা হাট এখানে বসত। গোটা অঞ্চলের পরিচিতি সেই হাট থেকেই। নদীপথে মালপত্র নিয়ে এসে বিক্রি হত হাটে।
সেই হাট আজও রয়েছে। বৃহস্পতিবার আর রবিবার বসে বড় হাট। তখন স্নো-পাউডার থেকে দা-কুড়ুল, সবই মেলে এই হাটে। তবে প্রতিদিন প্রধানত সব্জির পাইকারি বাজার হিসেবে কাজ করে এই হাট। আগে ছাগলের হাটও ছিল জমজমাট। এখন তা আর নেই। নানা এলাকায় দোকান-বাজার হয়ে গিয়ে, বাসিন্দাদের বহু প্রয়োজন মিটে যায় সেখানেই।
বাংলাদেশ-লাগোয়া বসিরহাটের চরিত্র বদলে যেতে শুরু করে ১৯৪৭ সালে, স্বাধীনতার পর থেকে। সীমান্তের ও পার থেকে বহু ছিন্নমূল মানুষ আশ্রয় নেন এ পারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়েও দেখা যায় একই চিত্র। ছিন্নমূল বহু মানুষ এ দেশে এসে ঘর বাঁধেন। বসিরহাটের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে লাগল। শহর বাড়তে লাগল, কিন্তু পরিকল্পনাহীন ভাবে। ‘বসিরহাট মহকুমার ইতিহাস’ বইটি লিখছেন পান্নালাল মল্লিক। বছর সত্তরের পান্নালালবাবু বললেন, “ছোটবেলায় যে শহর আমরা দেখেছি, তা দ্রুত বদলে গেল। মার্টিন রেলের লাইনের ধারে, ছোট-মাঝারি পুকুর বুজিয়ে, গাছপালা কেটে, বাড়ি তৈরি হতে লাগল।” পান্নালালবাবুর ধারণা, শহরের মধ্যে থেকে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ পুকুর অদৃশ্য হয়েছে। বাড়ির সঙ্গে বাগান, গাছপালা রাখার চল আর নেই।
অন্য দিকে, নতুন কল-কারখানা গড়ে উঠল না। বরং শহরের আশপাশে যে সব ধানিজমি ছিল, দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে গেল। ফলে ক্রমশ বদলে গেল অর্থনীতি। ষাট-সত্তরের থেকে শুরু হয় ইটভাটার রমরমা। আশির দশকে এল মেছোভেড়ি। পার্শে মাছ, গলদা, বাগদা চিংড়ির চাষ শুরু হল।
নব্বইয়ের শেষ থেকে শহর-লাগোয়া নদীর ধারে হাইব্রিড মাগুর চাষ। এগুলোর ফলে কিছু মানুষের হাতে টাকা এলেও, শহরের সুস্থ পরিবেশ নানা ভাবে ব্যাহত হতে লাগল। মাছ প্যাকিং করার কেন্দ্র, হাইব্রিড মাগুরের ফার্ম, এগুলো থেকে ওঠা দুর্গন্ধ বহু শহরবাসীর জীবন ওষ্ঠাগত করে তুলছে প্রতিনিয়ত। ইট ভাটা আর ভেড়ি শহর থেকে বৃষ্টির জল বেরোনোর জায়গা অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে। অপরিকল্পিত নির্মাণেও জল যাওয়ার জায়গা বুজিয়ে দিয়েছে। ফলে পাঁচটি খাল, আর ইছামতী থাকা সত্ত্বেও প্রতি বর্ষায় ভাসছে শহর। নগরবাসীর ভোগান্তি হয়েই চলেছে। বসিরহাট তার সমৃদ্ধিকে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে পরিণত করতে পারছে না।
সেই সঙ্গে ঘুলিয়ে উঠছে সামাজিক পরিবেশ। সীমান্তবর্তী শহর বসিরহাটে দানা বাঁধছে নানা অপরাধ। এখন বসিরহাট বারবার গরু পাচার, সোনা পাচার, নারী পাচারের জন্য বারবার খবরে উঠে আসছে। এই অপরাধচক্র কেবল সীমান্তেই থেমে থাকছে না। পাচারের ব্যবসায়ে ফুলে- ফেঁপে ওঠা দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্যে শহরের ব্যবসায়ীরাও জেরবার হয়ে যাচ্ছেন।
যদিও টাকার হিসেবে বিচার করলে, বসিরহাটের অর্থনীতি আগের চাইতে ঢের সমৃদ্ধ।
(চলবে)