মৃত্যুবার্ষিকী পালনের তোড়জোড় এলাকায়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
দু’বছরেও মেলেনি দোষীদের সাজা। স্থানীয় আদালতে চলা মামলার খুব বেশি অগ্রগতিও হয়নি। অভিযুক্তরা সকলে এখনও গ্রেফতার হয়নি। অভিযোগ, নাগাল মেলেনি ‘প্রকৃত’ অপরাধীদেরও। সিবিআই তদন্ত চেয়ে ইতিমধ্যেই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে সুটিয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের অন্যতম সাক্ষী নিহত বরুণ বিশ্বাসের পরিবার।
২০১২ সালের ৫ জুলাই গোবরডাঙা স্টেশনের কাছে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন শিয়ালদহের মিত্র ইনস্টিটউশনের (মেন) বাংলার শিক্ষক, বছর আটত্রিশের বরুণ। ওই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। মূল অভিযুক্ত, তথা সুটিয়া গণধর্ষণ কাণ্ডে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সুশান্ত চৌধুরী কয়েক মাস আগে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালীনই মারা গিয়েছে। ধৃত বাকি ৬ জনের মধ্যে এক জনের বয়স আঠারোর কম হওয়ায় জুভেনাইল আদালতে বিচার হয়েছে তার। সে তিন বছরের সাজা খাটছে। বাকি ৫ জনের বিচার চলছে বনগাঁ মহকুমা আদালতে।
২০০২-২০০৩ সাল পর্যন্ত গাইঘাটার সুটিয়ায় একের পর এক গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। শ্লীলতাহানী, খুন, তোলাবাজির জেরে অতিষ্ঠ ছিলেন স্থানীয় মানুষ প্রতিবাদী মঞ্চ গড়ে আন্দোলনে সামিল হন তাঁরা। নড়েচড়ে বসে পুলিশ-প্রশাসন। একে একে ধরা পড়ে দুষ্কৃতীরা। মোট ৩২টি মামলা রুজু করে পুলিশ। অভিযুক্ত ৩৮ জন। বরুণ ছিলেন প্রতিবাদী মঞ্চের সম্পাদক এবং একাধিক মামলায় অন্যতম সাক্ষী। সে জন্যই সুশান্ত চৌধুরীরা তাকে খুনের ষড়যন্ত্র করে বলে জানান তদন্তকারী অফিসারেরা।
বরুণ খুনের ঘটনায় ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বনগাঁ আদালতে জমা দেওয়া সিআইডির একশো পাতার চার্জশিটে ১০ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়। তাদের মধ্যে তিন জন পলাতক। ঘটনার ৮৭ দিনের মাথায় জমা পড়া ওই চার্জশিটে ৫২ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তারপর আদালতে চার্জগঠন করে শুরু হয় শুনানি প্রক্রিয়া। পুলিশ জানায়, ৫২ জন সাক্ষীর মধ্যে এখনও পর্যন্ত একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। তা-ও অসম্পূর্ণ। ওই সাক্ষী বরুণের দাদা অসিত। তিনিই মামলার অভিযাগকারী।
“বরুণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ওর বিচারের জন্য আমরা আমাদের মতো করে
যা যা করার, তা-ই করব। আমরা কোনও পরিবারের হাতে ব্যবহৃত হব না।” —ননীগোপাল পোদ্দার।
“প্রতিবাদী মঞ্চ বিক্রি হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক দলের কাছে। ওরা বরুণকে ভাঙিয়ে খেত।
ওদের মুখপত্রেরা বরুণের বিচার চেয়ে আন্দোলনের নামে অভিনয় করে গিয়েছে।” —অসিত বিশ্বাস।
কিন্তু কেন বিচার প্রক্রিয়া এত ধীর গতিতে চলছে?
বনগাঁ মহকুমা আদালতের মুখ্য সরকারী আইনজীবী (পিপি ইনচার্জ) সমীর দাস বলেন, ‘‘বরুণ হত্যা মামলার বাদী পক্ষ সিবিআই তদন্তের দাবিতে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। হাইকোর্ট তাতে সায় দেয়নি। মামলার প্রধান সাক্ষী বরুণের দাদা অসিত সাক্ষ্য দিতে সহযোগিতা করছেন না। তাঁকে আদালতের তরফে সাক্ষ্য দিতে বারবার ডাকা হচ্ছে। কিন্তু শরীর খারাপ-সহ নানা কারণ দেখিয়ে তিনি সময় চাইছেন। নিয়মিত সাক্ষ্য দিতে আসছেন না। অসিতবাবুর সাক্ষ্য সম্পূর্ণ না হলে অন্য সাক্ষীদের ডাকা যাচ্ছে না।” সমীরবাবু অবশ্য জানান, অসিতবাবু না এলেও দ্রুত অন্যদের সাক্ষ্য নেওয়ার কাজ এ বার শুরু করা হবে। কারণ, এ ভাবে চললে অভিযুক্তেরা জামিন পেয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া, যে অতিরিক্ত জেলা দায়রা বিচারক (ফার্স্ট ট্রাক ওয়ান)-এর এজলাসে মামলাটি চলছে, সেখানে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কোনও বিচারক নেই বলেও জানিয়েছেন সমীরবাবু।
সরকারী আইনজীবীর এই দাবি অবশ্য মানতে নারাজ অসিত। তিনি বলেন, “আসল খুনিদের গ্রেফতার করার ক্ষমতা সিআইডির নেই। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা কী ভাবে যেতে পারে। সিআইডিকে দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত সম্ভব নয়। সে কারণেই হাইকোর্টে সিবিআই তদন্তের আবেদন করেছি। হাইকোর্ট বলেছে, এর জন্য নিম্ন আদালতে কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। তার মাধ্যমেই আসতে হবে।” অসিতবাবুর দাবি, বরুণকে খুনের জন্য ৩ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়েছিল। কারা টাকা দিয়েছিল, তা এখনও জানা যায়নি। পাশাপাশি সুশান্ত চৌধুরী মারা যাওয়ায় বনগাঁ আদালতে মামলাটি নতুন করে ফাইল করতে হত। মাস দু’য়েক আগে শেষ বার হাজিরার সময় তা হয়নি। সে কারণে সময় লেগেছে।
৫ জুলাই গোবরডাঙা ও সুটিয়াতে প্রতিবাদী মঞ্চের তরফে স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। এখন চলছে তারই প্রস্তুতি। মঞ্চের তরফে সেখানে থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে বরুণের বাবা ও মাকে। কিন্তু ইতিমধ্যেই মঞ্চের সঙ্গে পরিবারটির দূরত্ব বাড়ার ইঙ্গিত মিলেছে এলাকায়।
প্রতিবাদী মঞ্চের সভাপতি ননীগোপাল পোদ্দার বলেন, “বনগাঁ আদালতে সাক্ষী দেওয়ার কথা বললে অসিত জানায়, সে মামলা হাইকোর্টে নিয়ে এসেছে। আর সে হাজির হবে কি হবে না, সেটা তাদের পারিবারিক বিষয়। এক বছর হল অসিতের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই।’’ ননীগোপালবাবুর কথায়, “আমরা চাই, যে ৫ জনের বিচার চলছে এখানে, তাদের যেন সাজা হয়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে আমরাও সিবিআই তদন্তের জন্য চেষ্টা করছি আমাদের মতো করে।” তিনি বলেন, “বরুণের পরিবারের প্রতি আমাদের কোনও ক্ষোভ নেই। বরুণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ওর বিচারের জন্য আমরা আমাদের মতো করে যা যা করার, তা-ই করব। আমরা কোনও পরিবারের হাতে ব্যবহৃত হব না।’’
কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি?
সে ব্যাপারে সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গিয়েছে সব পক্ষ। তবে অসিতবাবুর অভিযোগ, “প্রতিবাদী মঞ্চ বিক্রি হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক দলের কাছে। ওরা (মঞ্চ) বরুণকে ভাঙিয়ে খেত। ওদের মুখপত্রেরা বরুণের বিচার চেয়ে আন্দোলনের নামে অভিনয় করে গিয়েছে। এখন মুখোশ খুলে পড়ছে। মানুষ এর জবাব দেবেন।’’ বরুণের দিদি প্রমীলা রায়ের কথায়, ‘‘আমাদের সঙ্গে এত দিন নাটক করে গিয়েছেন ওঁরা।’’
বরুণের বিচারের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর। তাদের গাইঘাটা শাখার তরফে ৫ জুলাই নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি নন্দদুলাল দাস বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের কাছ থেকে বিচারের আশা আমরা করি না। কারণ এই খুনের পিছনে রাজ্যেরও মদত রয়েছে। রাজ্যের মন্ত্রীরও মদত আছে।’’ তবে এ ব্যাপারে সরাসরি কারও নাম উল্লেখ করেননি তিনি। এ বিষয়ে গাইঘাটার প্রাক্তন বিধায়ক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ঘটনা পরেই সিআইডির হাতে তদন্তভার তুলে দিয়েছিলেন। অভিযুক্তেরা গ্রেফতার হয়েছে। এখন কিছু মানুষ নোংরামো করার জন্য আসরে নেমেছে।’’
এত সবের মধ্যেও বরুণের খুনিদের সাজা দেওয়ার দাবি দিনে দিনে আরও জোরদার হচ্ছে এলwাকায়। বৃহস্পতিবার সকালে কথা হচ্ছিল স্থানীয় গৃহবধূ পুষ্প বিশ্বাসের সঙ্গে। খুনিদের আদৌ সাজা হবে কিনা, তা নিয়েই পুষ্পদেবীর মতো অনেকেই ইদানীং সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। ওই মহিলা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘‘আর কথা বলে কি হবে। আমাদের মতামত জানালে যদি বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত হত, তা হলে অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে হয়। আমরা সুটিয়ার সকলেই দ্রুত বরুণের খুনিদের বিচার চাইছি। কিন্তু পাচ্ছি কই। নিশ্চয়ই এর কোনও কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বড় কোনও মাথার প্রভাব রয়েছে।” স্পষ্টতই ক্ষিপ্ত তিনি। জগদীশ বিশ্বাস নামে এক বৃদ্ধ জানালেন, এত বড় ঘটনা ঘটল, অথচ এখন মনে হচ্ছে সঠিক বিচার পাওয়া যাবে তো! তাঁর কথায়, “যাঁরা বিচারের জন্য আন্দোলন করলেন, তাঁরা এরপরে হয় তো আর প্রতিবাদই করবেন না।’’
শুধু ধর্ষিতা মহিলাদের পাশেই নয়, বরুণ এলাকার বহু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্যও করেছেন। রাত-বিরেতে ছুটে গিয়েছেন। এমন যুবকটির জন্য এখনও প্রাণ কাঁদের অনেকের। বরুণের দেহ ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলেন সকলে, বরুণের আদর্শ ধরে রাখবেন সকলে। কিন্তু প্রতিবাদী যুবকটির পরিবারের সঙ্গে প্রতিবাদী মঞ্চের দূরত্বের ইঙ্গিত পেয়ে তাঁরাও হতাশ।