প্রথম ইনিংসে এক বছরের লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করতে বলেছিলেন সরকারি আধিকারিকদের। সেইমতো তৈরি হয়েছিল প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার। দ্বিতীয় ইনিংসে এক লপ্তে পাঁচ বছরের জন্য পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সব দফতরের সচিবকে বলা হয়েছে, অবিলম্বে এই ‘ভিশন ডকুমেন্ট’ তৈরি করে ফেলার জন্য। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘পরিকল্পনার রূপরেখা কী হবে, তা সচিবরা নিজের দফতরের কাজের অগ্রাধিকার বুঝে তৈরি করবেন।’’
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে মাথায় রেখে সম্প্রতি যে শিল্পোন্নয়ন ও প্রসার পর্ষদ তৈরি করেছেন মমতা, তার সাম্প্রতিক বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে প্রথমেই ছিল ‘ভিশন ডকুমেন্ট’ তৈরির বিষয়টি। কিন্তু পাঁচ বছরের জন্য পরিকল্পনা তৈরির এই নয়া নির্দেশ কেন? ওই শীর্ষ কর্তার কথায়,
‘‘এক বছরের প্রশাসনিক ক্যালেন্ডারে শুধু প্রকল্প শুরুর দিনক্ষণেরউল্লেখ থাকে। সেই প্রকল্প কবে শেষ হবে, তা বলা থাকে না। কিন্তু পাঁচ বছরের ভিশন ডকুমেন্ট তৈরি হবে প্রকল্প শেষের সম্ভাব্য সময়ও জানিয়ে দিতে হবে সচিবদের।’’ নবান্নের কর্তা বলছেন, এর ফলে এক দিকে যেমন প্রকল্প ঘিরে সংশ্লিষ্ট দফতরের দায়বদ্ধতা তৈরি হবে, তেমনই অন্য দিকে কোন দফতরের কোন প্রকল্প কবে শেষ হবে, তার একটা আন্দাজ পেয়ে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রয়োজনে প্রকল্পের অগ্রাধিকারও নির্দিষ্ট করে দিতে পারবেন তিনি। কোনও প্রকল্পে একাধিক দফতরের ভূমিকা থাকলে পর্ষদের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই তা নিয়ে আলোচনা হয়ে যাবে। ফলে জট ছাড়ানোও সহজ হবে।কী ভাবে তৈরি হবে ‘ভিশন ডকুমেন্ট’? সচিবদের প্রাথমিক ভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, নথিতে কেবল প্রকল্পের নাম, স্থান, সময়সীমা ও খরচের খুঁটিনাটি উল্লেখ করলেই চলবে না। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কী ধরনের বদল ঘটবে, তা-ও জানাতে হবে। নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘ধরা যাক কোনও প্রত্যন্ত এলাকায় নদীর উপরে একটা সেতু হলো। তার ফলে গঞ্জের সঙ্গে ওই গ্রামের কী রকম নিবিড় যান-যোগাযোগতৈরি হবে, কত লোকের কর্মসংস্থান বাড়বে, এলাকাবাসীরই বা কতটা আর্থিক সুরাহা মিলবে— প্রকল্পচূড়ান্ত করার আগে এ সবও যাচাই করতে হবে।’’
ক্ষমতায় আসার দু’বছর পর থেকেই প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার তৈরির কাজ শুরু করেছেন মমতা। সেখানে কোন দফতর কোন মাসে কী কাজ করবে, তার তালিকা দেওয়া থাকে। জেলা সফরে গিয়ে ওই ক্যালেন্ডার ধরেই কাজের অগ্রগতির খতিয়ান নেন মুখ্যমন্ত্রী। ক্যালেন্ডার মেনে কাজ না-হলে কৈফিয়ৎ তলব করেন। এ বার এই ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি ‘ভিশন ডকুমেন্ট’ তৈরি করে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখা তৈরি করতে চাইছেন তিনি।
কিন্তু নবান্নে তৃণমূলের দ্বিতীয় দফায় যে প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সেটা হল, টানাটানিরএই সংসারে উন্নয়নের জন্য আর্থিক সংস্থান হবে কী করে? শাসক দলের নেতারা অবশ্য বলছেন, কোষাগারের হাল যত খারাপই হোক, জনকল্যাণমূলক প্রকল্প বন্ধকরার কোনও প্রশ্নই নেই। কেননা, কন্যাশ্রী, সাইকেল-জুতো বিলি, বিভিন্ন ভাতা দেওয়ার প্রকল্পের জোরে বিরোধীদের একজোট হয়ে প্রচারকে যে ভোঁতা করে দেওয়া গিয়েছে, সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা ভোটই তার প্রমাণ। তাঁদের মতে, এই সব প্রকল্পের ফলে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ কোনও-না-কোনও ভাবে উপকৃত হয়েছেন। আর তারই প্রতিফলন ঘটেছে ভোটের বাক্সে।
তাই কেন্দ্র বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে বরাদ্দ কমালেও বা একেবারে বন্ধ করে দিলেও সেগুলিতে ইতি টানতে চান না মমতা। রাজ্যই উন্নয়ন প্রকল্পে যথাসম্ভব টাকা জোগাবে, জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তবে পুরনো প্রকল্প বন্ধ না-করলেও নতুন প্রকল্পে হাত দেওয়ার পরিকল্পনা এই মুহূর্তে সরকারের নেই। নবান্ন সূত্রের খবর, সচিবদের বলে দেওয়া হয়েছে, এখনই খুব একটা বড় কাজ হাতে নেওয়ার দরকার নেই, যে প্রকল্পগুলি চলছে সেগুলি কী ভাবে দ্রুত শেষ করে যায়, সেটাই দেখতে হবে। যদিও অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে প্রতি শুক্রবার শিল্পোন্নয়ন ও প্রসার পর্ষদের বৈঠক বসছে। সেখানেই নতুন প্রকল্প নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’