আমাকে নিয়ে চলো, পরীক্ষা দেবো

বাবার মুচলেকা নিয়ে চাইল্ডলাইনের কর্মীরা যখন উঠব উঠব করছেন, তখনই সে আর্তনাদ করে উঠল, ‘ও দিদি, আমাকে তোমরা নিয়ে চলো! তোমাদের কাছে থেকেই পরীক্ষা দেব। তোমরা চলে গেলেই মা-বাবা বিয়ে দিয়ে দেবে!’

Advertisement

সৌমেন দত্ত

মেমারি শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:০১
Share:

বাবার মুচলেকা নিয়ে চাইল্ডলাইনের কর্মীরা যখন উঠব উঠব করছেন, তখনই সে আর্তনাদ করে উঠল, ‘ও দিদি, আমাকে তোমরা নিয়ে চলো! তোমাদের কাছে থেকেই পরীক্ষা দেব। তোমরা চলে গেলেই মা-বাবা বিয়ে দিয়ে দেবে!’

Advertisement

মঙ্গলবারের দুপুর। বর্ধমানের মেমারির রসুলপুরের উল্লেরা-সোয়েরপাড়া গ্রামের একটি চাষি বাড়িতে হাজির বর্ধমান চাইল্ডলাইন। জটলা করেছেন পড়শিরা। এক উঠোন লোকের সামনে চাইল্ডলাইনের কর্মীদের কাছে ওই আবেদন রাখল যে নাবালিকা, সে এ বারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।

এই অবধি চিত্রনাট্যটা খুব অচেনা নয়। বাড়ির লোক জোর করে বিয়ে দিতে চায়। মেয়ে আরও পড়তে চায়। কিন্তু, নিজের বিয়ে রোখার জন্য যে একরোখা মনোভাব দেখিয়েছে রসুলপুরের বৈদ্যনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস টেনের ওই আদিবাসী ছাত্রী, তাকে বাহবা জানাচ্ছেন চাইল্ডলাইনের কর্তারা। মেয়েটির আর্জি মেনে তাকে বর্ধমানের একটি হোমে রেখে পরীক্ষা দেওয়ানোর ব্যবস্থা করবে চাইল্ডলাইন।

Advertisement

ঠিক কেমন লড়াই চালিয়েছে ওই নাবালিকা? বিয়ে নয়, পরীক্ষা দিতে চাই—এই দাবি নিয়ে প্রথমে মেমারি থানা পরে স্থানীয় পঞ্চায়েতের উপপ্রধানের কাছে গিয়েছিল বছর ষোলোর অঞ্জলি মান্ডি। তার অভিযোগ, সেখান থেকে কোনও সাহায্য পায়নি সে। শেষে নিজেই চাইল্ডলাইনের নম্বর জোগাড় করে ফোন করে। ওই ফোন পেয়েই চাইল্ডলাইনের কর্মীরা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ওই নাবালিকার বাড়ি গিয়ে জানতে পারেন, বিয়ে কাল, বৃহস্পতিবারই।

বিয়ে আটকাতে গাঁয়ে-গঞ্জে গিয়ে এর আগে নানা রকম বাধার মুখে প়ড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে চাইল্ডলাইনের। বাড়ির লোকেদের বোঝাতে কালঘাম ছোটে। ১৮-র নীচে মেয়ের বিয়ে দেওয়া আইনের চোখে অপরাধ, পুলিশে অভিযোগ দায়ের হবে—এমন নানা হুঁশিয়ারি দিয়ে বিয়ে না দেওয়ার মুচলেকা আদায় করতে হয় কর্মীদের। এ দিন উল্লেরা গ্রামে মেয়েটির বাড়িতে পৌঁছতেই চাইল্ডলাইনের কর্মীদের কাছে থাকা মুচলেকা চেয়ে নিয়ে নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দিতে চান না বলে লিখে দেন ওই পরীক্ষার্থীর বাবা রঘুনাথ মান্ডি। এত ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’ দেখেই খটকা লাগে তাঁদের।

চাইল্ডলাইনের বর্ধমান জেলার কো-অর্ডিনেটর অভিষেক বিশ্বাসের কথায়, “ব্যাপারস্যাপার দেখে মনে হচ্ছিল বটে, সব কিছু সাজানো! সে কথাই কিছুক্ষণ বাদে প্রমাণ করে দিল ওই পরীক্ষার্থী।’’ সকলের সামনে চাইল্ডলাইনের বর্ধমানের কাউন্সিলর মহুয়া গুঁইকে সে বলে ওঠে, ‘দিদি, আমি তোমাদের সঙ্গে চলে যেতে চাই। তোমাদের কাছে থেকে পরীক্ষা দেব। তোমরা চলে গেলেই বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দেবে’। এর পরেই মেয়েটিকে হোমে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই পরীক্ষার্থী চাইল্ডলাইনের কাছে অভিযোগ করেছে, বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেই গৃহশিক্ষককে পড়াতে নিষেধ করা হয়েছিল। এর পরেই পড়তে চায় জানিয়ে মেয়েটি প্রথমে মেমারি থানায় গিয়েছিল। তার পরে স্থানীয় পঞ্চায়েতের উপপ্রধানের কাছে। কিন্তু, কেউ তার কথা শোনেনি।

মহুয়াদেবী বলেন, “এ দিন থানায় ওই নাবালিকাকে নিয়ে যাওয়ার পরেই মহিলা পুলিশকর্মীদের কথা শুনে বুঝতে পারি, সে এখানে এসেছিল।” স্থানীয় দলুইবাজার ১ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান গীতা দাসও মেনেছেন, মেয়েটি তাঁর কাছে আসার আগে থানায় গিয়েছিল। ‘‘কিন্তু, পুলিশের উপর গিয়ে বিয়ে ঠেকাতে উদ্যোগী হব, সেটা ভাবিনি।”—বলছেন তিনি। মেমারি থানার ওসি দীপঙ্কর সরকার আবার বলেন, “কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। যে কোনও মাধ্যমে আমাদের কাছে খবর এলে, নাবালিকা বিয়ে আটকাতে আমরা তৎপর হই। চাইল্ডলাইনকে সাহায্য করেছি।”

প্রধান শিক্ষিকা সুতপা পাঁজা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মেয়েটির পড়াশোনার তাগিদ রয়েছে। ও আমাদের বলেনি, বাড়ির লোক বিয়ে ঠিক করেছে। যাই হোক, স্কুলের তরফ থেকে যা সাহায্য করার করা হবে।’’ আর অভিষেকবাবুর কথায়, ‘‘থানা, পঞ্চায়েতে গিয়ে কাজ না হওয়ার পরেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার যে সাহস দেখিয়েছে মেয়েটি, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন