—প্রতীকী চিত্র।
বিছানায় শুয়ে রোগা লিকপিকে বছর নয়ের ছোট্ট ছেলে। সেরিব্রাল পলসির দরুণ কথা বলতে পারে না সে। ছেলের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে গত এক দশকের কঠিন যুদ্ধের কথা বলছিলেন তার মা। দেশের নৌবাহিনীর এক সেনানী তথা প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁর সন্তানের পিতা বলে ন্যায্য হক আদায়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন মহিলা। জানা গিয়েছে, প্রথমে স্থানীয় পুলিশে এবং হাই কোর্টে যাওয়ার পরে বারুইপুরে নিম্ন আদালতে এই মামলা চলছে।
দক্ষিণ শহরতলির বাসিন্দা ওই মহিলা বলছিলেন, দশ বছর আগে কেরলের কোচিতে বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি করতে গিয়েই জনৈক নৌ সেনা অফিসারের সঙ্গে সম্পর্কেজড়িয়ে পড়েন।
মহিলার কথায়, “ওই অফিসার আমায় বিয়ের প্রস্তাবই দিয়েছিলেন। আমরা কোচিতে এক ফ্ল্যাটে থাকতাম। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ‘আমার স্বামী’ বলেই তিনি নিজের পরিচয় দিতেন। উনি (সেই নৌ অফিসার) জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগের বাসিন্দা। তখনও জানতাম না, তিনি বিবাহিত।”
অভিযোগকারিণী মহিলার দাবি, ২০১৫ সালের শেষের দিকে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন তিনি। এর পরে মুম্বইয়ে তাঁর বদলি হয়েছে বলে ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যান সেই প্রেমিক, ওইনৌ অফিসার।
অভিযোগকারিণীর কথায়, “উনি চলে যাওয়ার কয়েক দিন পর থেকেই আমার ফোন ধরছিলেন না। মানসিক বিপর্যয়ে কেরলে আর বেশি দিন চাকরিও করতে পারিনি। ফিরে আসি কলকাতায়।” প্রেমিকের কাছে প্রতারণার শিকার হয়ে কয়েক জন পারিবারিক বন্ধুর মাধ্যমে তিনি আইনজীবী শিবাশিস পট্টনায়েকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বলে দাবি মেয়েটির। শিবাশিস বলছেন, “সন্তানের বাবার কাছে ন্যায্য হক আদায়ে জম্মু-কাশ্মীরেও গিয়েছিলেন সেই নির্যাতিতা মা।”
২০১৬ সালে কলকাতায় শিশুপুত্রের জন্ম দেন মহিলা। তাঁর দাবি, সন্তানের জন্মের সময়ে হাসপাতালের তরফে যোগাযোগ করা হলে ওই নৌ অফিসার তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেননি। কিন্তু তার পরে ফের যোগাযোগ করা কঠিনহয়ে পড়ে।
শিবাশিস বলেন, “অন্য রাজ্যে নৌ অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ বলে আমরা প্রথমে জাতীয় মহিলা কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আমার সহকর্মীদের সঙ্গে দিল্লিতে গিয়ে কমিশনে অভিযোগ করেন ওই মহিলা। জাতীয় মহিলা কমিশন তখন জম্মু-কাশ্মীরের মহিলা কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা তলব করায় কাশ্মীরেও গিয়েছিলেন অভিযোগকারিণী।”
শিবাশিস জানান, কমিশনের প্রশ্নের মুখে এ বার সেই নৌ অফিসার নবজাতক এবং তার মায়ের সঙ্গে তাঁর ডিএনএ নমুনা মেলানোরদাবি তোলেন।
বিষয়টি নিয়ে মামলা গড়ায় কলকাতা হাইকোর্টে। মেয়েটি যেখানে থাকেন সেই থানায়ও অভিযোগ দায়ের করা হয়। সংশ্লিষ্ট নৌ অফিসার হাই কোর্টে জামিন নিয়ে নেন বলে দাবি। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতকে ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দেয়।
অভিযোগকারিণী ও তাঁর আইনজীবীর তরফে দাবি, নিম্ন আদালত প্রথমে কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক পরীক্ষাগারে ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু রক্তের নমুনা সংগ্রহ ও রিপোর্ট তৈরিতে দেরি হতে পারে বলে তারা জানায়। তখন আদালত বেলগাছিয়ার রাজ্য ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে তিন জনের রক্তের নমুনা পাঠাতে বলে। এই প্রসঙ্গে শিবাশিস বলছিলেন, “নমু্না সংগ্রহে দু’বার ত্রুটি হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। প্রথম বার পর্যাপ্ত রক্ত সংগ্রহ করা যায়নি এবং পরের বার নমুনায় অন্য কারও রক্ত মিশে গিয়েছে বলে আদালতে জানানল্যাবরেটরির কর্তারা।”
শিবাশিসের দাবি, “নিম্ন আদালতের বিচারক ফের মা, ছেলে এবং ওই অফিসারের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে রিপোর্ট পেশের নির্দেশ দিয়েছেন। কোনও গাফিলতিতে বেলগাছিয়ার ল্যাবরেটরির বিরুদ্ধে পদক্ষেপের হুঁশিয়ারিও তিনি দেন।” এ বার কোনও ত্রুটিতেহাই কোর্টে যাওয়ার কথা বলছেন শিবাশিস।
ছেলেকে আদর করতে করতে দু’চোখ ভরা জল নিয়ে অভিযোগকারিণী বলছেন, “আমার বাবা সম্প্রতি মারা গিয়েছেন। জামাকাপড়ের ছোটখাটো ব্যবসা করি। বছরখানেকের মধ্যে ছেলের জটিল অস্ত্রোপচার করানোর কথা। ওর চিকিৎসায় বসতবাড়ি বন্ধকও রাখতে হয়েছে। তবু যে ভাবে হোক, আইনি লড়াই চালিয়ে যাব!”
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে