এই টিনের ঘরেই দিন কাটাতে হচ্ছে ছিটমহলের বাসিন্দাদের।— নিজস্ব চিত্র
এক বছর কেটে গেল। কেউ কি কথা রেখেছে? রবিবার ছিটমহল হস্তান্তরের বর্ষপূর্তি। তার আগে এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে কোচবিহারের তিনটি ক্যাম্পে।
কারও বড় সংসারে মাসের সাত দিন না যেতেই নুন আনতে পান্তা ফুরোনো অবস্থা। কারণ, সরকারি রেশন ‘বাড়ন্ত’। কারও জন্মের সংশাপত্র নেই বলে স্কুলে ভর্তি হওয়া হচ্ছে না। কেউ এই বর্ষায় রাতের দিকে বাড়ি ছেড়ে বেরোতেই ভয় পাচ্ছেন। পাছে সাপে কাটে!
টিনের ঘরে, টিনের চালে একটা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কাটিয়ে দেওয়ার পরে ভারতকে ভালবেসে এ পারে চলে আসা সাবেক ছিটমহলবাসীরা এখন হিসেবের কড়ি গুনছেন। ওঁদেরই অনেকের আত্মীয়রা থেকে গিয়েছেন ও পারে। তাঁদের কাছ থেকে ভেসে আসছে বাংলাদেশের গল্প। শুনছেন, ও পারে নাকি এর মধ্যেই তৈরি হয়েছে ৬৭টি প্রাথমিক স্কুল, ১৪টি হাইস্কুল এবং একটি কলেজ। শুনছেন, ওদিকে নাকি প্রতি ছ’জনের জন্য একটি করে গভীর নলকূপ হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। বাংলাদেশের রেল ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে চাকরি পেয়েছেন ৭৮ জন।
গত বছর ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের পরে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন ৪১ হাজার মানুষ। আর এ পারের ক্যাম্পে রয়েছেন সাকুল্যে ৯২১ জন। বর্ষপূর্তির দিনে তাই তুলনাটা সহজেই এসে পড়ছে। যা দেখেশুনে সাবেক ছিটমহলবাসীদের জন্য এত দিন লড়াই চালিয়ে আসা নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় কমিটির মুখ্য সমন্বয়ক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলছেন, “সাবেক ছিটমহলগুলি যে অন্ধকারে ছিল, এখনও সেই অন্ধকারে।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘ইন্দিরা আবাস যোজনার পাকা ঘর করতে খরচ পড়ে ৩.১৫ লক্ষ টাকা। সেখানে টিনের বাড়ি তৈরি করে দিয়ে জেলা প্রশাসনের দাবি, খরচ হয়েছে ৫.৯০ লক্ষ!’’ জানাচ্ছেন, কোথাও এক কোদাল মাটি পড়েনি। কারও বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। এ সবের বিরুদ্ধে এ বার রাস্তায় নামবেন তাঁরা।
বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান ধুমধাম করে করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু বর্ষায় এলাকার অবস্থা খারাপ বলে সে অনুমতিও দেওয়া হয়নি প্রশাসনের তরফে। উল্টে দুর্নীতির সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে কোচবিহারের জেলাশাসক পি উলগানাথন বলেছেন, “বিধানসভা নির্বাচনের জন্য অনেকটা সময় কাজে হাত দেওয়া যায়নি। আবার বর্ষা নেমে যাওয়ায় উন্নয়ন কাজ করা যায়নি। এবারে দ্রুত গতিতে উন্নয়ন হবে।” একই কথা দিনহাটার বিধায়ক উদয়ন গুহেরও। তিনি আবার দীপ্তিমানদের এক হাত নিয়ে বলেছেন, ‘‘একটি সংগঠন ছিটমহলের বাসিন্দাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আমরা রাস্তায় নেমে একঘরে করে দেব।”
কিন্তু টিনের ঘরে বারো মাস কাটিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের চোখে জল। কেউ কেউ তো বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছেন বলেও খবর। ওই ঘরেরই সামনে বসে শতায়ু আজগর আলি বলছিলেন, ‘‘সেই কাদা, হ্যারিকেনের আলো আর দুর্গন্ধময় পানীয় জলই দেখছি আমাদের ভাগ্যে। পাকা বাড়ি কি মরার আগে দেখে যেতে পারব?’’