Water

আর্সেনিকে বিপন্ন প্রায় ৪৪ লক্ষ রাজ্যবাসী, বলছে রিপোর্ট

২০১৫ সালে ‘সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড’-এর সমীক্ষায় ধরা পড়ে, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি-সহ মোট ৮টি জেলার ৮৩টি ব্লক আর্সেনিকে ক্ষতিগ্রস্ত।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২০ ০১:২৮
Share:

ক্ষতিগ্রস্ত: আর্সেনিক-দূষিত জলের বিষক্রিয়া বারুইপুরের এক বাসিন্দার হাতে। ফাইল চিত্র

কলকাতা সংলগ্ন এলাকা-সহ রাজ্যের প্রায় ৪৪ লক্ষ মানুষের জীবন আর্সেনিকে বিপন্ন। কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রকের চলতি বছরের রিপোর্টে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। যা দেখে শুধু পরিবেশবিদরাই নন, চমকে উঠেছে জাতীয় পরিবেশ আদালতও। আদালতের তরফে এই সংখ্যাকে ‘উদ্বেগজনক’ (অ্যালার্মিং ফিগার) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত বলেছে, আর্সেনিকের নিরিখে দেশের মধ্যে অন্যতম খারাপ পরিস্থিতি হল পশ্চিমবঙ্গের। তাই রাজ্য সরকারকে ‘যুদ্ধকালীন’ ভিত্তিতে আর্সেনিকমুক্ত জল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। সম্প্রতি একটি মামলার প্রেক্ষিতে আর্সেনিকমুক্ত জলপ্রকল্পের সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছে আদালত।

Advertisement

যদিও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, জলশক্তি মন্ত্রকের রিপোর্টে উল্লিখিত সংখ্যার তুলনায় প্রকৃত অবস্থা আরও অনেক বেশি খারাপ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ়’-এর তরফে করা একাধিক সমীক্ষায় কলকাতা ও তার সংলগ্ন এলাকার আর্সেনিকের চিত্র উঠে এসেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, অন্য জেলা তো বটেই, কলকাতারই কিছু কিছু এলাকার জল আর্সেনিকযুক্ত। বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতা, গড়িয়া, বাঘা যতীনের জলে সম্প্রতি আর্সেনিকের সন্ধান মিলেছে। এর আগে রানিকুঠি, বাঁশদ্রোণী, নাকতলার জলেও আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছিল। জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি অনুযায়ী, সোনারপুর ও বারুইপুরের অবস্থা ‘খুবই খারাপ’ বলে জানাচ্ছেন গবেষকেরা।

জলের মধ্যে আর্সেনিকের উৎস নিয়ে গবেষকেরা জানাচ্ছেন, কোনও এলাকায় মাটির মধ্যে আর্সেনিকযুক্ত খনিজের উপস্থিতি থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় অধিক পরিমাণে জল তোলা হলে সেখানে এমন একটা ‘জিও-কেমিক্যাল’ পরিবেশ তৈরি হয়, তখন খনিজের মধ্যে মিশে থাকা আর্সেনিক বেরিয়ে এসে ভূগর্ভস্থ জলস্তর বা অ্যাকুইফারে মিশে যায়। কিন্তু বিপদের জায়গাটা হল, কোনও এলাকার জলে আর্সেনিক নেই, অথচ তা সত্ত্বেও সেখানকার মানুষদের শরীরে আর্সেনিক ঢুকতে পারে। কী ভাবে? এর ব্যাখ্যা করে ‘স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ়’-এর অধ্যাপক-গবেষক তড়িৎ রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘যে চাল ও আনাজ আমরা খাই, সেগুলি যেখানে চাষ হয়, সেগুলো বেশির ভাগই আর্সেনিকপ্রবণ এলাকা। নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, বর্ধমান, মালদহ-সহ একাধিক এলাকায় ভূগর্ভস্থ জল দিয়েই চাষ হয়। ফলে সেই জলে মিশে থাকা আর্সেনিক প্রথমে আনাজ ও চালে, তার পরে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ওই আর্সেনিক সব চেয়ে বেশি টক্সিক ও কার্সিনোজেনিক।’’

Advertisement

তবে প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, জলশক্তি মন্ত্রকের সাম্প্রতিক রিপোর্টই নয়, রাজ্যে একাধিক এলাকার জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি দীর্ঘদিন ধরেই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মাথাব্যথার কারণ। প্ল্যানিং কমিশনের আর্সেনিক সংক্রান্ত নথি বলছে, ১৯৮৮ সালে রাজ্য সরকার আর্সেনিক দূষণ নিয়ে প্রথম স্টিয়ারিং কমিটি তৈরি করেছিল। তার পর থেকে একাধিক টাস্ক ফোর্স এ বিষয়ে তৈরি করা হয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে এগিয়ে আসে কেন্দ্রও। ২০০৫ সালে প্ল্যানিং কমিশনের সদস্যের নেতৃত্বে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। সে সময়ে রাজ্যের প্রায় ৮৭ লক্ষ মানুষের জীবন আর্সেনিকে বিপন্ন ছিল।

২০১৫ সালে ‘সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড’-এর সমীক্ষায় ধরা পড়ে, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি-সহ মোট ৮টি জেলার ৮৩টি ব্লক আর্সেনিকে ক্ষতিগ্রস্ত। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে রাজ্য সরকারের তরফে ২০১৭ সালে ফের একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। সংশ্লিষ্ট টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান কুমারজ্যোতি নাথের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘রাজ্যে আর্সেনিকের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, সেটা বলা ঠিক হবে না। আর্সেনিক রোধে রাজ্য সরকারের তরফে সব চেষ্টাই করা হচ্ছে।’’

তবে রাজ্য সরকারের সেই চেষ্টা কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ২০১৫ সালে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা শুরু হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পরিবেশ আদালত সম্প্রতি নির্দেশ দেয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আর্সেনিকমুক্ত জলপ্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারলে রাজ্য পরিবেশগত ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি অন্য শাস্তিরও সম্মুখীন হতে পারে। ওই মামলার আবেদনকারী সুভাষ দত্তের কথায়, ‘‘আর্সেনিক বহু বছরের সমস্যা। কিন্তু তার পরেও এত লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন আর্সেনিকে বিপন্ন হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন