লোৎসে শৃঙ্গ অভিযানে এসেছিলাম এই বছর। সব ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। ১৯ তারিখ রুট ওপেন করতে গিয়ে এক জন শেরপা মারা যাওয়ায় সরকারি তরফে স্থগিত হয়ে গেল লোৎসে অভিযান। ১৮ দিন ধরে অপেক্ষা করেছি ক্যাম্প টু-তে, প্রায় সাড়ে ছ’হাজার মিটার উচ্চতায়। এত দিন ধরে এতটা উচ্চতায় কখনও থাকিনি আগে। একাধিক বার ওঠা-নামা করেছি ক্যাম্প থ্রি-তে।
এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গ অভিযানের পথ ক্যাম্প থ্রি পর্যন্ত একই। অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু লোৎসের রুট ওপেন হয়নি এখনও। সেই সঙ্গে বেশ খারাপের দিকে যাচ্ছে আবহাওয়া। বর্ষা এসে গিয়েছে প্রায়। বুধবার সকালে প্রচণ্ড হাওয়ায় তাঁবু প্রায় ছিঁড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, এ বার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। ফিরে যাওয়া উচিত। ক্যাম্প থ্রি থেকে সোজা বেসক্যাম্পে নেমে এসেছি বুধবার বিকেলে।
ওপরে থাকার সময়ই এক এক করে খারাপ খবরগুলো পেয়েছি। দুর্ঘটনা তো নতুন নয়, নতুন নয় মৃত্যুও। কিন্তু বড় কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই এত মৃত্যু, এত তুষারক্ষত, এত অসুস্থতা বোধ হয় আগে দেখেনি এভারেস্ট। ২০১০ সালে এভারেস্ট শৃঙ্গ ছুঁয়েছিলাম। এই একই পথে এসেছিলাম সে বারও। এ বছর তুলনামূলক ভাবে সহজ ছিল পথ। পরপর দু’বছরের দুর্ঘটনা সামলে অনেক সাবধানতায় খোলা হয়েছে অভিযানের রুট।
তবে যেটা চোখে পড়ল, অভিযাত্রীর ভিড় যেন বড্ড বেশি। ক্যাম্প টু-তে এত দিন ধরে থেকে চোখে পড়েছে বেশ কিছু বিষয়। প্রায় রোজই ওপর থেকে মৃত্যুর খবর এসেছে এক বা একাধিক অভিযাত্রীর। খবর এসেছে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার। যাঁরা নেমে আসছেন সকলেই বড্ড বিধ্বস্ত, অসুস্থ, ক্লান্ত। প্রায় রোজই তুষারক্ষত নিয়ে নেমে এসেছেন কোনও না কোনও আরোহী। আমার তো আরোহণ স্থগিত ছিল, তাই যতটা সম্ভব সাহায্য করছিলাম সবাইকে। আমার টেন্টটা যেন ছোটখাটো একটা চিকিৎসালয়ই হয়ে গিয়েছিল।
দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে বহু অভিযাত্রী এসেছেন এ বার, যাঁদের প্রথম বড় শৃঙ্গ অভিযান শুরু এভারেস্ট দিয়েই! এর আগে এতটা উচ্চতায় শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতাই নেই অনেকের। তাই বিপদের মাত্রা এত বেড়েছে বলে আমার মত। আনকোরা আরোহীরা অভিযান শুরুর জন্য বেছেছেন এভারেস্টকে। আমার আট-হাজারি শুরুও এভারেস্ট দিয়েই। কিন্তু তার আগে কামেট, নন্দাকোট, চৌখাম্বা, শিবলিঙ্গের মতো একাধিক ছয় বা সাত হাজারি শৃঙ্গ অভিযানের অভিজ্ঞতা ছিল।
বারবার বেশি উচ্চতায় নিজেকে সুস্থ রাখার অভিজ্ঞতা থেকে যে দক্ষতা জন্ম নেয়, তা সমতলের হাজার অনুশীলনেও সম্ভব নয়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই পারদর্শিতা আর দক্ষতার অভাব বিপদের একটা বড় কারণ হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে পরিশ্রম কম করার প্রবণতা। যে পথে অন্তত দুই থেকে তিন বার লোড ফেরি (নীচের ক্যাম্প থেকে কিছু জিনিস নিয়ে ওপরের ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়া ও নেমে আসা) করে আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া জরুরি, সে পথে হয়তো মাত্র এক বার ফেরি করছেন অভিযাত্রীরা। ফলে উচ্চতার সঙ্গে ভাল করে খাপ খাচ্ছে না তাঁদের শরীর। আর অবধারিত ভাবে এর মাসুল ওপরে উঠে গুনতে হচ্ছে।
আর একটা বিষয় নিয়ে অসংখ্য অভিযাত্রী সমস্যায় পড়েছেন, সেটা অক্সিজেন। গত দু’বছর অভিযান বাতিল হয়েছে। সেই অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলিই এ বছর ব্যবহার করা হয়েছে এভারেস্ট অভিযানে। ফলে প্রেশার-বার নেমে গিয়ে এক একটা সিলিন্ডার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম সময় চলেছে। আর এই কারণে সাউথ কলের ‘ডেথ জোন’-এ গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন বহু অভিযাত্রী।
সেই সঙ্গে চোখে পড়ার মতো বদলেছে আবহাওয়া। পাহাড়ে আবহাওয়ার দ্রুত বদল কোনও নতুন কথা নয়। কিন্তু এ বছর যে ক’টা দিন ভাল আবহাওয়ার পূর্বাভাস বা ‘উইন্ডো’ ছিল, সে দিনগুলোতেও বারবার দুর্যোগের মুখে পড়তে হয়েছে অভিযাত্রীদের।
এই মুহূর্তে বেসক্যাম্প ব্যস্ত উদ্ধারকাজে। সেখানেও খারাপ আবহাওয়ায় বারবার বাধা পাচ্ছে হেলিকপ্টারের উড়ান। এখনও কোনও ভারতীয় আরোহীর দেহ নীচে নামানো হয়নি। শুনেছি, ক্যাম্প ফোরের নীচে ইয়েলো ব্যান্ডের কাছে মারা গিয়েছেন সুভাষ পাল। খোঁজ নেই গৌতম ঘোষ ও পরেশ নাথের। তাঁদের উদ্ধারের জন্য ছ’জন দক্ষ শেরপার একটি দল কাঠমান্ডু থেকে বুধবারই বেসক্যাম্পে এসে পৌঁছেছে। আবহাওয়া ভাল থাকলে বৃহস্পতিবারই হেলিকপ্টারে করে ক্যাম্প টু পৌঁছে যাবেন তাঁরা।
(লেখক পাঁচটি আট-হাজার মিটার শৃঙ্গ ছোঁয়া প্রথম বাঙালি)