একটু ছোঁয়ার চেষ্টা। ফুলজামের শিবমন্দিরে। — অভিজিৎ সিংহ
ছবিটা প্রায় এক। দু’বছর আগের এক গরমে তাঁকে নিয়েও তো এমনই মাতামাতি হয়েছিল! প্রথমবার বাঁকুড়ায় তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে প্রচার করতে নেমেছিলেন মুনমুন সেন। পরেরটা ইতিহাস। সিপিএমের হেভিওয়েট প্রার্থী বাসুদেব আচারিয়াকে লোকসভায় বিপুল ভোটে হারানো।
এ বারও সেই বাঁকুড়া। ফারাক বলতে লোকসভার বদলে বিধানসভা ভোট। তৃণমূলের প্রার্থী আবারও এক চিত্রতারকা। সোহম চক্রবর্তী। যিনি এ বার লড়ছেন বড়জোড়া কেন্দ্র থেকে। সোমবার শিবরাত্রি থেকে প্রচারের সলতে পাকানো শুরু করে দিলেন ‘অমানুষ’, ‘জামাই ৪২০’ বা ‘কাটমুন্ডু’-র নায়ক।
এবং ফিরে এল সেই ২০১৪ সালের ছবিটা।
‘ওই তো, ওই তো সোহম’— গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে যখনই কোনও গাড়ি ঢুকেছে গঙ্গাজলঘাটির ফুলজামের শিবমন্দিরের দিকে, শিবরাত্রির পুজোয় আসা হাজার খানেক মানুষের ভিড় এ ভাবেই চিৎকার করতে করতে দৌড়ে গিয়ে সেই গাড়ি ঘিরে ধরেছে। কিন্তু গাড়ির দরজা খুলতেই হতাশা। এ তো নায়ক নয়!
কেউ সকাল ন’টা, কেউ দশটা থেকে নায়ক দেখতে মন্দিরে ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন এ দিন। সোহমের ছোট বেলার ছবি কী কী, কোন কোন ছবিতে তিনি ‘হিরো’, এ সব নিয়ে যখন রীতিমতো আলোচনা শুরু হয়েছে শিবথানের বিক্ষিপ্ত জটলায়, তখনই লাল ধুলো উড়িয়ে ঢুকল নায়কের গাড়ি। সামনে পুলিশের এসকর্ট ভ্যান।
মুহূর্তে মুড বদল জনতারও।
চলন্ত গাড়ির পিছনে ছুটছে শ’দুয়েক কচিকাঁচা থেকে মাঝবয়সী লোকজন। ‘ইটাই নায়কের গাড়ি’ বলে মন্দির থেকে ছুট মারল জটলা। মন্দির চত্বরে সোহমের গাড়ি পৌঁছনোর আগেই হাজার খানেক লোক হামলে পড়েছে গাড়িতে। অনেকে গাড়ির উপরে ছাদে উঠে যাচ্ছেন। নায়ককে অক্ষত অবস্থায় মন্দিরে নিয়ে যাওয়াটাই তখন চ্যালেঞ্জ পুলিশ থেকে শুরু করে তৃণমূল কর্মীদের। কোনও মতে গাড়ি থেকে নেমে দলীয় কর্মী ও পুলিশের ঘেরাটোপে মন্দির পানে কার্যত দৌড় লাগালেন ‘লে হালুয়া লে’-র ছবির নায়ক! কিন্তু, ভিড়ের চাপে হোঁচট খেলেন মন্দিরে ঢোকার সরু দরজায়। ততক্ষণে কে সোহমের সঙ্গে মন্দিরে ঢুকবেন, তা নিয়ে দলীয় কর্মীদের মধ্যেই হাতাহাতি বাধার উপক্রম।
এক কর্মীরই কনুইয়ের গুঁতোয় চোখ থেকে চশমা ছিটকে গেল নায়কের। ঠেলাঠেলির মাঝেই কোনও মতে সেটাকে এক হাতে লুফে নিলেন সোহম। ‘আপনারা শান্ত হন’ বলে চিৎকার করে উঠলেন এক পুলিশ কর্মী। মন্দিরের দরজা বন্ধ করে কড়া লাগিয়ে দলীয় কর্মীদের বাইরে আটকাল পুলিশ। মন্দিরে মিনিট দশেক পরে পুজো দিয়ে যখন নায়ক বের হচ্ছেন তখনও পরিস্থিতি এক। নায়ক দর্শনে এর তার ঘাড়ে উঠে পড়ার ডোগাড় লোকজনের। সোহম তখন দু’হাত বুকে চেপে দৌড় মারছেন কর্মীদের ঘেরাটোপে। এ ভাবে কোনও মতে গাড়িতে গিয়ে বসলেন নায়ক। কিন্তু, গোটা গ্রামই তখন গাড়ির সামনে। এ দিন সোহমকে ঘিরে এমনই উন্মাদনা ছিল বড়জোড়ার বাবা ভুবনেশ্বর মন্দিরে বা মানাচর পল্লিশ্রীর কালী মন্দিরে।
যা দেখে জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেই ফেললেন, “সোহম রেকর্ড ভোটে জিতছেন, এটা নিশ্চিত”। বড়জোড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য গোপাল দে-র কথায়, “মানুষ সোহমকে প্রার্থী হিসেবে পেয়ে খুশি।’’
নেতারা যতই আত্মবিশ্বাস দেখান, খোদ নায়কের কথাতেই অবশ্য নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে। বড়জোড়ার একটি হোটেলে সোহম এ দিন বলেন, “জয়ের পথে আমার কোনও বাধা আসবে না। তবু বলি, আমি সবাইকে নিয়ে এক সাথে কাজ করতে চাই।’’
দলেরই একাংশের মতে, বড়জোড়ায় স্থানীয় প্রার্থী না দেওয়ায় তৃণমূলের একাংশে ক্ষোভ আছে। বিরোধীদের সঙ্গে সঙ্গে এই ভোটে সেই বিক্ষুব্ধ দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধেও তাঁকে লড়তে হবে, এটা নায়ক টের পেয়েছেন। পাশাপাশি, নায়ক দেখার ভিড়ের কতটা ভোটের সময় সোহমের ঝুলিতে যাবে, প্রশ্ন আছে তা নিয়েও। ফুলজামের মন্দিরে সোহমকে দেখতে এসেছিলেন ঘনশ্যামপুরের কলেজ পড়ুয়া ধনঞ্জয় ভান্ডারি, গৌরী মণ্ডলরা। তাঁদের সাফ কথা, ‘‘আমরা নায়ক দেখতে এসেছি। এ বারই প্রথম ভোটও দেব। অনেক নেতাই আগে উন্নয়নের কথা বলে ভোট নিয়েছেন। কিন্তু কিছু করেননি। এলাকার বন্ধ কারখানাও খোলেনি, রাস্তাঘাট, নিকাশি ব্যবস্থাও হয়নি। কাজের লোক বুঝেই ভোট দেব।’’
কলকাতার সোহমকে এলাকার মানুষ কি কাজের লোক বলে ভাবছেন? প্রশ্নটা থেকেই গেল।