নিশ্চিন্তির ফাঁক গলে ফের দাঁত-নখ কুষ্ঠের

‘দানব’ নিকেশ হয়েছে ভেবে প্রহরীরা নিশ্চিন্তে হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, সে মরেনি। স্রেফ ঘুমিয়ে ছিল। পাহারা নেই দেখে ফের সংহারমূর্তি ধরছে। এটাই হল ভারতে কুষ্ঠরোগের বর্তমান অবস্থান। বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের আক্ষেপ, স্বাস্থ্য দফতরের নজরদারির অভাবেই কুষ্ঠ ফের জেগে উঠছে। ঠিক যেমন জেগেছে যক্ষ্মা।

Advertisement

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:০৫
Share:

‘দানব’ নিকেশ হয়েছে ভেবে প্রহরীরা নিশ্চিন্তে হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, সে মরেনি। স্রেফ ঘুমিয়ে ছিল। পাহারা নেই দেখে ফের সংহারমূর্তি ধরছে।

Advertisement

এটাই হল ভারতে কুষ্ঠরোগের বর্তমান অবস্থান। বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের আক্ষেপ, স্বাস্থ্য দফতরের নজরদারির অভাবেই কুষ্ঠ ফের জেগে উঠছে। ঠিক যেমন জেগেছে যক্ষ্মা।
২০০৫-এ গড়ে এক লক্ষের মধ্যে এক জনও কুষ্ঠরোগী না-পাওয়ায় ভারতকে ‘কুষ্ঠমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, দেশে এখন গড়ে এক লক্ষে কুষ্ঠরোগী অন্তত ৯ জন। যে সব রাজ্যে রোগীর বহর চোখে পড়ার মতো বেড়েছে, তার অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ। পুরুলিয়া এ রাজ্যের সর্বাধিক কুষ্ঠকবলিত জেলা।
এবং এই পরিস্থিতির নেপথ্যে ‘আত্মতুষ্টি’র বড় ভূমিকা। মন্ত্রকের খবর, ভারত কুষ্ঠমুক্ত ঘোষিত হওয়ার পরে বিভিন্ন রাজ্যে এই চর্মরোগটি সম্পর্কে সচেতনতাবৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যপরীক্ষায় ভাটা পড়ে যায়। এমনকী, ডাক্তারির কোর্সে কুষ্ঠ গুরুত্ব হারায়। ফলে এখন যাঁরা ত্বকের রোগ নিয়ে পড়াশোনা করছেন, কুষ্ঠ তাঁদের কাছে প্রায় অজানা বিষয়।

পশ্চিমবঙ্গের হালও তথৈবচ। কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের কুষ্ঠ বিভাগটি পাট গুটিয়েছে। ব্লক স্তরের যে সব স্বাস্থ্যকর্মী কুষ্ঠ প্রতিরোধে নিয়োজিত ছিলেন, গত বছর দশেক তাঁরা অন্য কাজে ব্যস্ত। স্বাস্থ্য দফতরের খবর: আগে ফি ব্লকে কুষ্ঠ নির্ণয় ও প্রতিরোধ কর্মসূচি তদারকির জন্য এক জন মেডিক্যাল অফিসার থাকতেন। যাঁর অধীনে ছিলেন তিন সহকারী অফিসার ও দশ স্বাস্থ্যকর্মী। কুষ্ঠ নির্ণয়ের শিবির বসতো সপ্তাহে দু’দিন। ২০০৫-এর পরে সেই ‘লেপ্রসি স্টাফেরা’ নেই। ওঁদের ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, আন্ত্রিক প্রতিরোধের কাজে লাগানো হচ্ছে।
‘‘এতেই কাল হয়েছে।’’— বলছেন কুষ্ঠ-গবেষকদের অনেকে। ওঁদের বক্তব্য: স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা বন্ধ হওয়ায় উপসর্গ সত্ত্বেও রোগ দ্রুত ধরা পড়ছে না। স্বাস্থ্যকর্মীরাও কুষ্ঠ সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল নন। সচেতনতার ঘাটতিতে অজ পাড়াগাঁয়ে রোগ ভয়াবহ চেহারা নিচ্ছে।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ডার্মাটোলজি’র চিকিৎসক সত্যেন্দ্রনাথ
চৌধুরী কুষ্ঠ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। ‘‘চর্মরোগের তালিকায় কুষ্ঠ প্রথমে। হেলাফেলার জেরে রোগটা ফের চাগাড় দিচ্ছে,’’ বলছেন তিনি। ন্যাশনাল মেডিক্যালের ডার্মাটোলজি’র প্রধান চিকিৎসক সুদীপ দাসের পর্যবেক্ষণ— কুষ্ঠ সংক্রান্ত তৎপরতায় আচমকা রাশ টানা উচিত হয়নি। ওঁর কথায়, ‘‘জেলায় কাজের সূত্রে দেখেছি, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঠিকঠাক ওষুধ পাঠানো হচ্ছে না। আরও নানা টালবাহানা। বারবার
অভিযোগ করেও ফল হয়নি।’’
এ সবেরই খেসারত গুনতে হচ্ছে। সুদীপবাবুর দাবি, এখনকার কুষ্ঠ আরও মারাত্মক, সংক্রামকও বটে। কুষ্ঠ প্রতিরোধে নিযুক্ত এক আন্তর্জাতিক সংস্থার পুরুলিয়া জেলার প্রধান সুধাকর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নজরদারি একান্ত জরুরি। সরকারের উচিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকে ব্যাপক ভাবে সামিল করা।’’
স্বাস্থ্যভবন কী বলে?
কুষ্ঠ ফের জেগে উঠেছে মেনে নিলেও অবহেলার অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। লেপ্রসি স্টাফেরা যেমন অন্যান্য রোগ দেখছেন, তেমন অন্য কর্মীরা কুষ্ঠের দিকে নজর রাখছেন।’’
বস্তুত ‘কুষ্ঠমুক্তি’র ধারণা যে ঠিক ছিল না, বাড়তি নজরদারির সুবাদেই তা ফাঁস হচ্ছে বলে অধিকর্তার দাবি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement