মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সিনেমা-ব্যবসায়ী শ্রীকান্ত মোহতার দখলে থাকা জমি উদ্ধারে এ বার খোদ পুলিশ কমিশনারের দ্বারস্থ হলেন কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ। অতীতে একাধিকবার স্থানীয় স্তরে পুলিশের সাহায্য চেয়ে পাওয়া যায়নি। জমি দখলে গিয়ে বাধা পেয়ে ফিরতে হয়েছে বন্দর কর্তাদের। এ বারও কাজের কাজ কিছু হবে কি না, সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত নন।
তারাতলার পি-৫১ হাইড রোডে ১০০ কাঠা জমি গত তিন বছর ধরে বেআইনি ভাবে দখল করে শ্রীকান্তবাবু পাঁচটি স্টুডিও চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ বন্দর কর্তৃপক্ষের। তাঁদের দাবি, এই জমি ব্যবহার করা নিয়ে শ্রীকান্তবাবুর সংস্থার সঙ্গে বন্দরের কোনও চুক্তিই নেই। ওই জমি থেকে ভাড়া বাবদ বছরে কমপক্ষে ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু শ্রীকান্তবাবুর সংস্থা বন্দরকে একটা পয়সাও দেয় না।
জমির দখলদারি নিয়ে মামলা গড়িয়েছে হাইকোর্ট পর্যন্ত। জমি দখল নেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের কাছে আদালতের নির্দেশও রয়েছে বলে দাবি বন্দর কর্তৃপক্ষের। কিন্তু পুলিশের সাহায্য না-পাওয়ায় সেই কাজ আটকে রয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ। এক বন্দর কর্তার কথায়, ‘‘জমি উদ্ধারে তারাতলা থানার সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু শ্রীকান্তবাবু মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ হওয়ায় থানা স্তরের অফিসারেরা কার্যত হাত গুটিয়ে রয়েছেন।’’ এ বার তাই সরাসরি কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থকে চিঠি লিখে ‘ফোর্স’ চেয়েছেন বন্দর-চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালোঁ।
বন্দর সূত্রে বলা হচ্ছে, তারাতলার ওই জমির দাম প্রায় ৫০ কোটি টাকা। জমিটির ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে জাহাজ মন্ত্রক। তাই বন্দর কর্তৃপক্ষও এ বার তেড়েফুঁড়ে নেমেছেন। কাহালোঁ ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, ‘‘বন্দর যে জমির মালিক, তার দখল তো বন্দরকে নিতেই হবে। বেআইনি দখলদারদের সরাতে হবে।’’
আইনশৃঙ্খলা যে হেতু রাজ্যের বিষয়, তাই লালবাজারে চিঠি দিয়ে পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। পুলিশকে সঙ্গে নিয়েই তাঁরা বেদখল জমি উদ্ধার করতে চান। কিন্তু চিঠি পেলেও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সিঙ্গাপুর-ঢাকা ঘুরে আসা এবং তাঁর আসন্ন লন্ডন সফরের সঙ্গী শ্রীকান্ত মোহতার দখলে থাকা জমি উদ্ধারে পুলিশ আদৌ উদ্যোগী হবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। বার বার ফোন করা হলেও পুলিশ কমিশনার ফোন ধরেননি। এসএমএসের জবাব দেননি।
বন্দর সূত্রের খবর, লালবাজারের কর্তারা গড়িমসি করলে কেন্দ্রীয় শিল্প নিরাপত্তা বাহিনীর (সিআইএসএফ) সাহায্যে জমির দখল নেওয়ার চেষ্টা হবে। বন্দরের অছি জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় জাহাজমন্ত্রী নিতিন গডকড়ীর সঙ্গে কথা বলেছি। মন্ত্রক যে কোনও উপায়ে ওই জমি উদ্ধার করবে।’’
শ্রীকান্তবাবুর সংস্থা বন্দরের জমি দখল করল কী ভাবে?
১৯৬৯ সালে পি-৫১, হাইড রোডের প্রায় ১৮৫ কাঠা জমি অ্যাভেরি ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড নামে ওজন যন্ত্র নির্মাতা সংস্থাকে লিজ দিয়েছিল কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট। মাসিক ভাড়ার ভিত্তিতে লিজের মেয়াদ ছিল ৩০ বছর। ১৯৯৯ সালে লিজ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ জমির দখল নিতে গিয়ে দেখেন, অন্তত চার-পাঁচটি সংস্থা সেখানে নানা ধরনের স্থায়ী কাঠামো বানিয়ে ফেলেছে।
জমির দখল নিতে ২০০০ সালে দ্য পাবলিক প্রেমিসেস (এভিকশন অব আনঅথরাইজড অকুপ্যান্টস) ১৯৭১ আইনে এস্টেট আদালতে মামলা করেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর কর্তারা জানান, মামলার সময়ে অ্যাভেরির হয়ে আদালতে হাজির হন এলএমজে কনস্ট্রাকশন নামে একটি সংস্থার প্রতিনিধিরা। তাঁরা দাবি করেন, অ্যাভেরির হয়ে ওই জমির রক্ষণাবেক্ষণ তাঁরাই করেন। সুতরাং তাঁদের সংস্থার সঙ্গেই ওই জমির লিজ নবীকরণ করুক বন্দর। এস্টেট আদালতে মামলা চলে ১১ বছর। শেষে ২০১১ সালের ৭ মার্চ কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের এস্টেট অফিসার সব জবরদখলকারী সরিয়ে ওই জমি দখল নেওয়ার রায় দেন।
এস্টেট অফিসারের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আবেদন করে এলএমজে কনস্ট্রাকশন। কিন্তু কোনও আদালতই ওই রায়ের উপরে স্থগিতাদেশ দেয়নি বলে বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি। বন্দরের ভূমি সংক্রান্ত বিভাগের এক কর্তা জানান, ২০১২ সালের জুনে জমি উদ্ধার করার জন্য যখন প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, তখন খবর পাওয়া যায়, সেখানে নতুন করে বেআইনি নির্মাণ শুরু হয়েছে। তাঁরা সেখানে গিয়ে দেখেন, বিভিন্ন শেড তৈরি করে স্টুডিও তৈরির কাজ চলছে। মোট ১৮৫ কাঠা জমির মধ্যে প্রায় ১০০ কাঠা দখলে নিয়েছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস নামে একটি সংস্থা। যার মালিক মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ শ্রীকান্ত মোহতা। ওই কর্তার অভিযোগ, তাঁরা নির্মাণ কাজ বন্ধ করতে গিয়ে বাধা পান। তারাতলা থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
জমি ব্যবহারের ব্যাপারে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যে তাঁদের চুক্তি নেই তা মেনেছেন শ্রীকান্তবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘আমার সঙ্গে বন্দরের কোনও সম্পর্ক নেই। ওই জমি আমি এলএমজে-র কাছ থেকে ‘সাব লিজ’ নিয়েছি। এ জন্য তাদের ভাড়াও দিচ্ছি।’’ কিন্তু জমির মালিক বন্দর কর্তৃপক্ষ। এলএমজে বা অন্য কোনও সংস্থার সঙ্গে ১৯৯৯-এর পর থেকে তাঁদের কোনও লিজ চুক্তিও নেই। ফলে শ্রীকান্তবাবুর যুক্তি কতটা আইনসঙ্গত সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। শ্রীকান্তবাবুর অবশ্য বক্তব্য, ‘‘ওই জমি নিয়ে মামলা চলছে। তবু বন্দর কর্তৃপক্ষ জমি দখল করতে চাইছেন! এর পিছনে কোনও যড়যন্ত্র নেই তো?’’
বন্দর কর্তৃপক্ষের পাল্টা বক্তব্য, জমি দখলের ব্যাপারে কোনও স্থগিতাদেশ নেই। তাই আইন মেনেই তাঁরা নিজেদের জমি ফিরে পেতে চেয়েছেন। কিন্তু বারবার খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁদের। পুলিশ কোনও সময়েই বেআইনি দখল হটাতে সাহায্য করেনি। ২০১৩ সালের ২৬ অগস্ট বন্দরের এস্টেট অফিসার আবার জানান, হাইড রোডের জমি থেকে সমস্ত বেআইনি দখলদারদের সরিয়ে দিয়ে বন্দরের হাতে তা ফেরানোর জন্য পুলিশি সহায়তা প্রয়োজন। সে বারেও পুলিশ নীরবই ছিল।
কেন? লালবাজারের কর্তারা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস দেখিয়ে সাধ করে কে আর শাসক দলের বিরাগভাজন হতে চাইবেন! তাঁরা মনে করাচ্ছেন, কিছু দিন আগে কর ফাঁকির অভিযোগে ওই সিনেমা ব্যবসায়ীর অফিসে তল্লাশি চালাতে গিয়ে নবান্নের ফোন পেয়ে হাত গুটিয়ে ফিরতে হয়েছিল বাণিজ্য কর বিভাগের কর্তাদের। লেক মলের ক্ষেত্রেও শ্রীকান্তবাবুর ইচ্ছামতো যাবতীয় সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করে দিয়েছে কলকাতা পুরসভা। স্ট্যাম্প ডিউটি ও রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ যাতে তাঁকে কম টাকা দিতে হয়, সে জন্য লিজ চুক্তি দু’ভাগে ভাঙার প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও তাতে রাজস্ব ক্ষতি হবে ২৪ কোটি টাকা। তার উপর ওই সেই মল বন্ধক রেখে যাতে তিনি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পান, সেই ব্যবস্থাও করে দিয়েছে পুরসভা।
এমন ‘দাপুটে’ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেও মুখ বুজে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করছেন পুলিশ কর্তারা।