কলকাতায় বড় স্পাই নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল আখতার, জাফর

কলকাতা থেকে আট-দশজন যুবককে দুবাই হয়ে পাকিস্তান যেতে সাহায্য করেছিল আইএসআই গুপ্তচর সন্দেহে শহর থেকে গ্রেফতার আখতার খান। কলকাতায় বসে সে ওই যুবকদের পাসপোর্ট পেতে সাহায্য করেছিল বলে গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৫ ১৮:১২
Share:

আখতার ও জাফর।

কলকাতা থেকে আট-দশজন যুবককে দুবাই হয়ে পাকিস্তান যেতে সাহায্য করেছিল আইএসআই গুপ্তচর সন্দেহে শহর থেকে গ্রেফতার আখতার খান। কলকাতায় বসে সে ওই যুবকদের পাসপোর্ট পেতে সাহায্য করেছিল বলে গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি।

Advertisement

কলুটোলা থেকে ওই ব্যক্তিকে ভারতীয় জালনোট-সহ গ্রেফতার করার পর তাকে জেরা করে গোয়েন্দারা জেনেছেন, শহরের বিভিন্ন জায়গার বাসিন্দা ওই যুবকদের পাসপোর্ট পেতে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়েছিল আখতার। ওই পাসপোর্ট তৈরির সময় ঠিক মত ‘ভেরিফিকেশন’ করা হয়নি বলে গোয়েন্দারা প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছেন। এক তদন্তকারী অফিসার মঙ্গলবার বলেন,‘‘ আখতার এবং তার ভাই জাফরকে জেরা করে আমরা বেশ কয়েকজনের নাম জানতে পেরেছি যারা ওই যুবকদের পাসপোর্ট পেতে সহয়তা করেছিল। আমরা সব খতিয়ে দেখছি।’’ সেই সঙ্গে গোয়েন্দারা ওই দু’জনকে জেরা করে জানতে পেরেছে শহরে বেশ কয়েকজনকে তথ্য সংগ্রহের কাজে লাগিয়েছিল ওই দুই ভাই। ওই যুবকদের নাম জানতে পারলেও তাঁদের কোন খোঁজ গোয়েন্দারা এখনও জানতে পারেনি বলে লালবাজার সূত্রের খবর।

Advertisement

পড়ুন দাদার চর-চক্রে দোসর ভাইও পাকড়াও

শনিবার আখতারকে পাকড়াও করার পর তাঁকে জেরা করে সোমবার গ্রেফতার করা হয় তার ভাই জাফর খানকে। কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) ওই দু’জনকে গ্রেফতার করেছিল। মঙ্গলবার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে জাফরকে হাজির করানো হলে মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট সঞ্জয়রঞ্জন পাল তাকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

এসটিএফ সূত্রের খবর, পাকিস্তানি গুপ্তচর সন্দেহে শহর থেকে গ্রেফতার হওয়া দুই ভাইয়ের দু’রকম দায়িত্ব ছিল বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, বড় ভাই আখতার খানের দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনী এবং পুলিশের গোপন খবর সংগ্রহ করে তা পাকিস্তানে পাঠানো। অপর দিকে ভাই জাফর খানের দায়িত্ব ছিল কলকাতা বন্দরের বিভিন্ন তথ্য জোগার করা। বন্দর সংক্রান্ত নথি পাচার হওয়ায় বন্দরের নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন গোয়েন্দারা। দুই ভাইয়ের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া বিভিন্ন নথি খতিয়ে দেখার পর কলকাতায় কোনও ‘স্লিপার সেল’ তৈরি করা হচ্ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখছেন কলকাতা পুলিশের এসটিএফের গোয়েন্দারা। তবে এই ‘স্লিপার সেল’ কোনও জঙ্গিহানার বদলে মহানগরে শক্রপক্ষের চরবৃত্তির কারণেই বেশি তৈরি কাজেই নিয়োগ করা হত বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি জঙ্গিদের সাময়িক আশ্রয় দেওয়ার জন্যও এই নেটওয়ার্ককে কাজে লাগানো যেত কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন।

গোয়েন্দাদের ব্যাখ্যা, পাক গুপ্তচর সংস্থা এবং জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি এমন নানা কাজের টোপ দিয়েই স্লিপার সেল তৈরি করে। এদের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে শহরের বিভিন্ন পকেটে নিজেদের নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এরা সব সময় যে নিজেরাই কোনও হামলা চালাবে, এমনটা নয়। বরং এলাকার বিভিন্ন যুবকদের জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মী করে তুলবে। কখনও কখনও ক্যুরিয়ার হিসেবেও কাজ করানো হয় এই ধরনের এজেন্টদের। এই নেটওয়ার্কও তেমন কোনও কাজ করত কি না, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে গোয়েন্দারা মনে করছেন।

আখতার ও তার দলবল সেনা প্রতিষ্ঠানগুলির কী ধরনের তথ্য পাচার করেছে, তা-ও খতিয়ে দেখতে চান সেনা গোয়েন্দারা। প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দারা জানান, সেনা ও বন্দরের বেশ কিছু ছবি আখতার এবং জাফরের কাছে মিলেছে। ই-মেলে যে সব ছবি পাচার করা হয়েছে, সেগুলিও উদ্ধার করা হয়েছে। এই সব ছবিগুলি কীসের, সেনা অফিসারেরা তা খতিয়ে দেখবেন বলে খবর। তবে দুই ভাই হোয়াটঅ্যাপের মাধ্যমে যে তথ্য পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল তা উদ্ধার করা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন গোয়েন্দারা। এক সেনাকর্তার ব্যাখ্যা, উপগ্রহ-চিত্র থেকেই এখন বিভিন্ন জায়গার ছবি মেলে। তা সত্ত্বেও আখতারদের কী কাজে লাগানো হয়েছিল, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।

সেনা বাহিনীর আর এক অফিসার বলছেন, নানা ধরনের কাজের ছুতোয় বা ঠিকা শ্রমিক সেজে অনেকেই ফোর্ট উইলিয়াম বা পানাগড়ের ছাউনিতে ঢোকে। ভিতরের টুকটাক ছবি বা ম্যাপ তারা দেখতে পায়। পাশাপাশি, আখতারেরা কোন স্তরে নিজেদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল, সেটাও খতিয়ে দেখার বিষয়। সেনাবাহিনীর একাংশের ব্যাখ্যা, সেনাবাহিনীর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘অপারেশনাল প্ল্যানিং’। কিন্তু সেটার পুরোটা নিচুতলার কর্মী-অফিসার এমনকী মাঝারি মাপের অফিসারদের কাছেও পুরোটা থাকে না। আলাদা আলাদা ভাবে ভাগ হয়ে তা শীর্ষস্তরে যায় এবং সেখানেই ছক তৈরি হয়। আখতারদের নেটওয়ার্ক সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার পর্যন্ত পৌঁছে ছিল কি না, সেটাই দেখার। এক সেনা অফিসারের কথায়, ‘‘উচ্চকর্তা পর্যন্ত পৌঁছনো সাধারণ চরের কাজ নয়। এরা যদি তেমন কিছু করে থাকে, তা হলে মেনে নিতে হবে এই ষড়যন্ত্রের শিকড় অনেক গভীরে।’’ যদিও সেনাবাহিনীর আর একটি অংশ আখতারদের ষড়যন্ত্রের শিকড় গভীরে এমন তত্ত্ব মানতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, সেনা ছাউনির ভিতরের ম্যাপ বা টুকটাক ছবি মিললেও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ঢোকার অনুমতি থাকে না। সেনা ছাউনির ভিতরে বাইরের লোক ঢুকলে তাদের উপরে নজরদারিও থাকে।

জম্মুর উপদ্রুত এলাকায় কাজ করে আসা এক সেনা অফিসার বলছেন, কাশ্মীরের এক সেনা ছাউনিতে সাফাই, আগাছা সাফ করার কাজ করার জন্য স্থানীয় কয়েক জন লোককে নিয়োগ করা হয়েছিল। ওই লোকেরা ছাউনিতে আসলেই কয়েক জন জওয়ান গল্পের ছলে নজরদারি করত। বাইরের লোকেদের সামনে যুদ্ধের ছক কিংবা জঙ্গিদের তত্ত্বতালাশ নিয়ে কেউ কথাও বলত না। ‘‘আমরা জানতাম, ওই লোকগুলির মধ্যে দু’-এক জন জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মী। তাই ওদের একটু এড়িয়েই চলত বেশির ভাগ জওয়ান,’’ বলছেন ওই সেনা অফিসার। গোয়েন্দাদের একাংশ অবশ্য বলছেন, আখতার ও তার ভাই বার টেন্ডার হিসেবে বিভিন্ন পার্টিতে যেত। সেই সূত্রে বিভিন্ন তথ্য জেনে তা পাক গুপ্তচরদের পাচার করত।

গোয়েন্দাদের একটি সূত্র বলছে, আখতারেরা তেমন বড় মাপের চর নয়। কিন্তু এরা এ রাজ্যে লুকিয়ে থাকা বড় চরদের হদিস জানতে পারে। সেই কারণেই গোয়েন্দাদের একাংশের ছক ছিল, আখতারদের নজরবন্দি করে ষড়যন্ত্রের আরও তত্ত্বতালাশ করা। কিন্তু গ্রেফতারের খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সেটা এখন আর সম্ভব নয় বলেই গোয়েন্দা অফিসারদের একাংশের ধারণা।

এ দিন আদালতে ধৃত জাফরের আইনজীবী ফজলে আহমেদ খান দাবি করেন, জাফরের কাছে কোনও নকল পাসপোর্ট বা জাল নোট পাওয়া যায়নি। দিদির তপসিয়ার বাড়ি থেকে দু’দিন আগে বেআইনি ভাবে তাকে আটকে রেখে পরে গ্রেফতার করেছে এসটিএফ। এই অভিযোগের জবাবে সরকারি আইনজীবী অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় আদালতে বলেন, আখতারকে জেরা করে জাফরের নাম পাওয়া গিয়েছিল। ১৪ নভেম্বর জাফরকে দেখা করতে বলে পুলিশের তরফে নোটিস পাঠানো হয়। তিনি এসে কথা বলে যান। ১৫ নভেম্বর ফের তাঁকে নোটিশ পাঠিয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্দেহজনক তথ্যপ্রমাণ পেয়েই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ দিন আদালতে সাওয়াল জবাবের সময় সরকারী আইনজীবী দাবি করেন, ১৯৯০ সালে পাকিস্তানে যায় জাফর খান। নিজের নাম বদলে সেখানে পাকিস্তানি পাসপোর্টও বানায় সে। ২০০৬ সালের মার্চ থেকে ২০০৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নেয় জাফর।

আদালতে এসেছিলেন জাফর খানের আত্মীয়রাও। আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে জাফরের দিদি সুরাইয়া বেগম অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁর ভাইকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে। জাফর কোনওদিন পাকিস্তান যায়নি বলে দাবি করেন তাঁর স্ত্রী রুকসানা বেগম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন