দইওয়ালার বেশে মণীশ মিত্র। — নিজস্ব চিত্র।
বিশ শতকের চল্লিশের দশক। পোল্যান্ড তখন নাৎসি বাহিনীর দখলে। রাজধানী ওয়ারশ-এর বন্দি শিবিরেই মঞ্চস্থ হল রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’! উদ্যোক্তা ইহুদি ডাক্তার জানুস করজ্যাক। অভিনয়ে তাঁরই অনাথ আশ্রমের ১৯২টি শিশু। পরের ইতিহাসটা নির্বিচার গণহত্যার!
সাত দশকেরও বেশি সময় পর সেই পোল্যান্ডের মাটিতেই ফিরছে ‘ডাকঘর’। পরিচালনার দায়িত্বে কলকাতার মণীশ মিত্র। ওয়ারশ-এর ‘থিয়েটার ইনস্টিটিউট’-এ ভারত আর পোল্যান্ডের শিল্পীরা মঞ্চস্থ করতে চলেছেন অমল ও দইওয়ালার গল্প। ইতিহাসের এক নৃশংস অধ্যায় আর দু’দেশের সাংস্কৃতিক সৌহার্দ্য তুলে ধরার ভাবনা থেকেই এই প্রয়াস, জানালেন মণীশবাবুরা।
১৮৭৮ সালের ২২ জুলাই একটি ইহুদি পরিবারে জন্ম হয়েছিল করজ্যাকের। ছোট থেকেই সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক ছিল। পড়াশোনা অবশ্য চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনা চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পরে পুরোপুরি ভাবে সাধারণের সেবায় সঁপে দেন নিজেকে। ওয়ারশ-য় গড়ে তোলেন দু’-দু’টি অনাথ আশ্রম। ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ডের দখল নেয় নাৎসিরা। রাজধানী ওয়ারশ-র বন্দি শিবিরের আওতায় চলে আসে করজ্যাকের আশ্রমগুলিও।
তবু থমকে যাননি করজ্যাক। উঁচু পাঁচিল, কাঁটাতারে ঘেরা শিবিরের মধ্যেই শিশুদের মুক্তির পাঠ দিতেন। শিবিরের মধ্যেই ছিল অনাথ শিশুদের নিজস্ব পার্লামেন্ট। ছিল আদালত। এমনকী সাপ্তাহিক সংবাদপত্রও প্রকাশ হতো সেখান থেকে। তত দিনে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ দেশের সীমা ছাড়িয়েছে। ১৯৪২-এর ১৮ জুলাই শিশুদের নিয়ে ওই বন্দি শিবিরেই সেই রবীন্দ্র-নাটক মঞ্চস্থ করলেন করজ্যাক। নাটক শেষ হওয়ার পরেও বেশ কিছু ক্ষণ রা কাড়েননি দর্শকেরা। তাঁর লেখা ডায়েরি ‘ওয়ারশ
ঘেটো’র বিবরণ থেকে পরে জানা গিয়েছিল, স্থানীয় ভাষায় অমলের
গল্প মন ছুঁয়ে গিয়েছিল আবালবৃদ্ধবনিতার। নাটকের মহড়ার সময় থেকেই অমলের সঙ্গে আত্মিক যোগ গড়ে উঠছিল শিশুদের। অমলের মতো তারাও রাজার চিঠি, অর্থাৎ বন্দিদশা থেকে মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে।
মূল গল্পে রাজার লেখা চিঠি পায়নি অমল। কিন্তু ‘ডাকঘর’ মঞ্চস্থ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সাক্ষাৎ মৃত্যুর পরোয়ানা চলে আসে বন্দি শিবিরে। সেখানে রাজার নাম অ্যাডল্ফ হিটলার।
অগস্টের শুরুতেই করজ্যাক ও তাঁর শিশুদের সরিয়ে নিয়ে আসা হয় ট্রেবলিংকা-র শ্রমশিবিরে। সেখান থেকে সোজা ‘গ্যাস চেম্বার’। বিষাক্ত কার্বন-মনোক্সাইডে দমবন্ধ ৭ অগস্ট। মৃত্যু হয় সকলেরই। সে দিন করজ্যাক আর তাঁর শিশুদের যাঁরা সামনে থেকে দেখেছিলেন, পরে তাঁরাই জানিয়েছিলেন, মৃত্যু নিশ্চিত এ কথা জেনেও ট্রেবলিংকা যাওয়ার সময় এতটুকু ভয়ের ছাপ ছিল না কারও মুখে। একে অপরের হাত ধরে করজ্যাকের পিছু পিছু এগিয়ে যাচ্ছিল শিশুরা। কান্নাকাটি দূর অস্ত্, কেউ পালানোর চেষ্টাও করেনি। কেউ লুকিয়ে পড়েনি। অজানা কোনও কারণে করজ্যাককে ছাড় দিতে চেয়েছিল নাৎসিরা। তবু শেষ যাত্রায় শিশুদের সঙ্গ ছাড়েননি তিনি।
করজ্যাক আর তাঁর শিশুদের মনে রেখে আগামী ২১ জুলাই ওয়ারশ-এ ফের মঞ্চস্থ হবে ‘ডাকঘর’। তার আগে ১৮ জুলাই বিশেষ কিছু দর্শকের উপস্থিতিতে সেটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পোল্যান্ডের একটি
স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংস্থা এ ব্যাপারে সাহায্য করছে মণীশবাবুদের। মূল নাটকটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গান ও কবিতা থাকছে এ বারের ‘ডাকঘরে’। ১৮ জুলাইয়ের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য নেওয়া হচ্ছে করজ্যাকের ডায়েরির। নাটকটিতে এক দিকে বাংলা ভাষার ব্যবহার যেমন থাকছে, তেমনই ব্যবহার করা হচ্ছে ইংরেজি ও পলিশও। পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় বাংলা অংশটি পলিশে অনুবাদ করা হবে।
নাটকে অংশ নিচ্ছেন পোল্যান্ডের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মারিয়া পোমিয়ানওস্কা। রবীন্দ্রনাথের গান এস্রাজে বাজাবেন তিনি। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পোল্যান্ড উড়ে যাচ্ছেন ভারতীয় অভিনেতা-সঙ্গীতশিল্পী জয়দীপ সিংহ, সীমা ঘোষ। যাচ্ছেন অভিনেতা রাজু বেরাও। নাটকে অংশ নিচ্ছেন জার্মানির বাসিন্দা আদতে ভারতীয় অভিনেতা উৎসব দত্ত। সামিল হচ্ছেন মার্কিন পরিচালক পল বার্গেটো। থাকছেন নিউ ইয়র্কবাসী পোল্যান্ডের অভিনেতা আন্না পোডোলাকও।
বন্দি শিবিরের যেখান থেকে করজ্যাক আর তাঁর শিশুদের ট্রেবলিংকা-র ট্রেনে তোলা হয়েছিল, সেখান থেকেই নাটক শেষে বের হবে দীর্ঘ মিছিল। গানে, বাজনায় পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবেন ওঁরা সকলে। পরে বাংলা আর ইংরেজিতে নতুন করে নাটকটি পরিবেশনার ভাবনা রয়েছে মণীশবাবুর। নভেম্বরে ভারতেও নাটকটি মঞ্চস্থ করার কথা ভাবছেন তাঁরা।