এক মাস আগের কলকাতা সফরে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার সম্পর্কে ছিল নীরবতা। তাতে বিভ্রান্তিও ছড়িয়েছিল বিস্তর। এ বার কলকাতায় এসে মমতার জমানায় পশ্চিমবঙ্গে একেবারে গোড়ার গলদ নিয়েই সরব হলেন অমিত শাহ। এ রাজ্য সম্পর্কে শিল্প ও বণিক মহল যা হামেশাই বলে থাকে, বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি সেই অভিযোগেই আক্রমণ শানালেন তৃণমূলের সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ করলেন, এখনকার বাংলায় বিনিয়োগের পরিবেশই নেই। কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় ধর্ম মেনে যত সাহায্যই করুক, বাংলায় নিরাশার অন্ধকার তাই কাটছে না!
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, মমতার রাজ্যে এসে অমিত যে দিন এই আক্রমণ করছেন, সে দিনই দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের জন্য আর্থিক সাহায্য চাইছেন। মমতা-মোদী সাক্ষাতের কয়েক ঘণ্টা আগেই পরিসংখ্যান সহযোগে অমিতের আক্রমণ বুঝিয়ে দিয়েছে, রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলকে রেয়াত করতে চায় না বিজেপি। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে তার প্রাপ্য সাহায্য দিয়েছে এবং দেবে। কিন্তু যে রাজ্যে সারদার মতো দুর্নীতির অভিযোগ আসে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিদিন সমস্যা হয়, সেখানে বিনিয়োগ করতে আসবে কে— এই মূল প্রশ্নটাই এ দিন ফের তুলে দিয়েছেন অমিত। আর সেই সঙ্গেই বাতলে দিয়েছেন এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর রাস্তাও! তাঁর সাফ কথা, বাংলার মানুষই পারেন এই অন্ধকার কাটাতে! অর্থাৎ ২০১৬-য় সরকার উল্টে দিতে!
কলকাতায় ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্সের অনুষ্ঠানে পূর্বাঞ্চলের আর্থিক বিকাশ সংক্রান্ত আলোচনাসভায় অমিত বলেন, ‘‘রাজ্যের উন্নয়নে ঢালাও অর্থ-সাহায্যের জন্য কেন্দ্র যখন প্রস্তুত, তখন রাজ্য সেই সুযোগ নিতে ব্যর্থ।’’ বিস্তারিত পরিসংখ্যান-সহ অমিত দাবি করেন, ইউপিএ আমলে যে পরিমাণ অনুদান পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি পাচ্ছে এনডিএ জমানায়। বাংলার মাটিতে তৃণমূলকে জমি না ছাড়ার বার্তা দিয়ে অমিত বলেছেন, স্বাধীনতার সময় বাংলা ছিল দেশের প্রথম সারির রাজ্য। তার পরে দীর্ঘকাল বাম শাসনে তার পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তৃণমূলের হাত ধরে এখানে পরিবর্তন হয়েছিল। অমিতের কথায়, ‘‘কিন্তু এ কোন পরিবর্তন? রাজ্যের সর্বত্র এখন ঘোর নিরাশার পরিবেশ!’’
কেন এই নিরাশা? বিজেপি সভাপতির ব্যাখ্যা, ‘‘আমিও দীর্ঘদিন সরকারে ছিলাম। রাজ্যে কিছু করতে হলে পরিবেশটাই সহায়ক হওয়া দরকার। কিন্তু যে রাজ্যে বিনিয়োগের টাকা সারদায় চলে যায়, যখন-তখন বিস্ফোরণ হয়, আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না, সেখানে শিল্প-বিনিয়োগ হবে কোথায়?’’ অমিতের মতে, টাকা পেলেও উন্নয়ন নজরে পড়ছে না। রাজ্যকে কেন্দ্র থেকে পাওয়া টাকার ঠিক ব্যবহার জানতে হবে। তাঁর আক্ষেপ রাজ্য সরকারের প্রতি ভরসা নেই শিল্পপতিদের। কারণ, সরকার শিল্পের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ। বাংলা পরিণত হয়েছে নিরাশার রাজ্যে!
এই নিরাশা থেকে বেরনোর উপায় কী? জানতে চেয়েছিলেন এক শিল্পপতি। অমিতের জবাব, ‘‘বাংলার মানুষকেই এর জবাব দিতে হবে। এই অবস্থা থেকে বেরনোর উপায় বিকাশের পথ এবং এনডিএ-র গৃহীত নীতির অনুসরণ।’’ উন্নয়নের প্রশ্নে বিজেপি রাজনীতি করে না বোঝাতে অমিতের আরও দাবি, পূর্বাঞ্চলে ঝাড়খণ্ড ছাড়া কোনও রাজ্যেই বিজেপি ক্ষমতায় নেই। কিন্তু খনি নিলাম করে যে অর্থ পাওয়া গিয়েছে, তার পুরোটাই রাজ্যগুলিকে ফিরিয়ে দেওয়ার নীতি মোদী নিয়েছেন। ইতিমধ্যে ২০টি খনি নিলাম করে দু’লক্ষ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। তা বাংলা-সহ পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির কোষাগারেই যাবে।
অমিতের আক্রমণে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ শাসকদল। তৃণমূল নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় পাল্টা বলেন, ‘‘কলকাতায় এসে অমিত শাহ আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এখানে খুন আর বোমাবাজির রাজনীতি হচ্ছে। আসলে বোমা আর দাঙ্গার মধ্যে দিয়ে ওঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে! ফলে, এ ছাড়া উনি আর কী বলবেন?’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গের কিছুই জানেন না! কেন্দ্রের বিভিন্ন দফতরের পরিসংখ্যান অনুসারে বেশ কিছু ক্ষেত্রে গত চার বছরে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থান অধিকার করেছে। নিজেদের ব্যর্থতা ডাকতে উনি এ সব বলছেন!’’ তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, ‘‘ভাবা হয়েছিল, বাংলায় পদ্মফুল ফুটেছে। আসলে কুঁড়িও ফোটেনি! বাংলার মানুষই ওঁদের জবাব দিয়েছেন।’’
সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে এ দিনই আরএসএসের অধীন ‘যোগক্ষেম’ আয়োজিত বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানেও বক্তা ছিলেন অমিত। তিনি, জম্মু-কাশ্মীরের উপ মুখ্যমন্ত্রী নির্মল সিংহ এবং সঙ্ঘ নেতা সুরেশ জোশী জম্মু-কাশ্মীরের ইতিহাস এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অবদান নিয়ে আলোচনা করেন। সুরেশ বলেন, ‘‘শুধু কাশ্মীর নয়, শ্যামাপ্রসাদের জন্মভূমি বাংলাও আমাদের।’’