জয়ন্তীর বন্য চাঁদ বা ছাতিমতলার অপার্থিব বিষাদ!

বিষাদ বোঝার আগে শিশু আকাশে চাঁদমামা চিনে ফেলে। আমার শৈশবের বাঘাযতীন পার্কে এমনই চাঁদ উঠত।

Advertisement

সেবন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৯ ১০:০৭
Share:

আমার জন্মের কিছুকাল পরেই ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই মানুষের হাজার হাজার বছরের সেই গুহাবাসী জীবনের বিস্ময় মুগ্ধতা থেকে বংশপরম্পরায় চলে আসা লোককথা, উপকথা, পুরাণ, গালপল্প ছেড়ে চাঁদ এক পাথুরে প্রমাণের উপগ্রহে পরিণত হয়ে গেল। নিল আর্মস্ট্রং তাঁর চন্দ্র অভিযানের মাধ্যমে স্বপনচারিণী চাঁদকে হাতের মুঠোর স্পর্শে এনে দিলেন। তাই অামার জ্ঞান হওয়া ইস্তক এই চন্দ্রদেব খাতায়-কলমে মানে বিজ্ঞান-ভিত্তিতে রহস্যহীন!

Advertisement

তবু কি সেই কলঙ্ক আবিষ্কার হয়ে যাওয়া, পাহাড়-মাটি আর অনালোকিত অন্য পিঠের অবধি ছবি জেনে নেওয়া চাঁদ কি ধরা দিল? চামড়া, রক্ত, মাংস, মেদ, মজ্জার নীচে খটখটে অস্থিময় কঙ্কাল আছে জেনেও প্রণয়ীকে গোলাপ ভ্রমে চুম্বন করি যেমন, তেমনই চাঁদের শরীর উপাদান থেকে গেল নিছকই তথ্য-জ্ঞানভাণ্ডারে! পরম বেরসিকও আজন্মপরিচিত পূর্ণিমার চাঁদ একবার না একবার ঘাড় উঁচিয়ে দেখে ফেলেন। আর, আশ্চর্য এই যে, একাকী চাঁদদর্শনে তেমন ফুর্তিভাব জাগে না। এক বিষাদ-কুয়াশা মিহি সরের মতো দুধের পেয়ালায় ভেসে ওঠে।

বিষাদ বোঝার আগে শিশু আকাশে চাঁদমামা চিনে ফেলে। আমার শৈশবের বাঘাযতীন পার্কে এমনই চাঁদ উঠত। এক-দু’টো বাদে সবক’টা বাড়ি ছিল একতলা। টিন অার কাঠের ছাদ। ক্যাঁচক্যাঁচে আওয়াজ ওঠা কাঠের কোমরসমান পলকা গেট। গরাদহীন খোলা বাইরের বারান্দা। একান্নবর্তী পরিবার। খাঁচা, বেড়া, মঞ্চের অাড়াল ছাড়া অবারিত মাঠ। সন্ধ্যার পর নির্জন। লোডশেডিং নিত্যসঙ্গী। সত্তরের অস্থির সময়। বারান্দায় মোড়া পেতে ঠাকুমা, আমি, কখনও ঠাকুরদা, ছোটকা বসে থাকি। নৈশ কলেজের কাজ সেরে বাবা দুই সহকর্মীর সঙ্গে বাড়ি ফিরবেন। এমনই একদিন, চাঁদের আলোয় ভোরের আলোর মতো মায়া ছেয়ে আছে যখন, বাড়ির সামনে কাঠের পথবাতির খাম্বার মরা হলুদ আলো শুধু নীচটাকে বৃত্তাকারে আলো করে রেখেছে। এমন সময় কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অমলতাস বিছানো পথে ডোরাকাটা পাজামা পরা একটা ছেলে দৌড়ে এল। খোলা বারান্দা আর বাধাহীন মাঠ বলে তার দৌড়টা অনেকটা অবধি দেখা গেল। এবার দূরত্ব রেখে পিছনে দু’তিনটে ছেলে। সামনে দৌড়ে যাওয়া ছেলেটিকে তারা বোধ হয় বাচ্চু বলে ডাকছিল। আমরা কেউই মোড়া বা বেতের সোফা ছেড়ে উঠিনি। দেখা গেল, বড়দের মুখ বেশ গম্ভীর। বাবা একটু পরেই চলে গেলেন। ফিসফাস শুরু হল। পরদিন বেলার দিকে শুনলাম, মাঠ পেরিয়ে কলেজমুখো এক একতলা স্টুডিয়োয় কার যেন টুকরো করা লাশ। অমন নরম চাঁদের আলোয় ত্রস্ত জেব্রার মতো ডোরাকাটা পাজামার পিছনে ওই ‘পলাতক ও অনুসরণকারী’ কি আমার স্বপ্নে বা কল্পনায় এসেছিল? বাড়িতে আর কখনও এই দৃশ্য নিয়ে কেউ তো কথা বলেনি! কেবল ওই নির্ঝরের মতো চাঁদ দীর্ঘ বিষাদে ডুবিয়ে দিয়েছিল!

Advertisement

আর এক বন্য চাঁদ ছিল নির্জন বনবাংলোর ধারে, জয়ন্তী নদীর পাড়ে। এমএ পাশ করে ফিরে এসেছি। সদ্য প্রেম ভেঙেছে। সে কী চাঁদের আলো! নদীর ওপারে ভুটান পাহাড় অবধি স্পষ্ট। রাত বাড়ছে। সুনসান চৌহদ্দি। গার্ড এসে দু’বার বাংলোয় ফিরতে বলে গিয়েছেন। কিন্তু ওই জোছনা অপ্রতিরোধ্য! টেনে নিয়ে যাচ্ছে শুকনো পাথর-ভরা নদীর বুকে। সঙ্গের তিন বন্ধু জোর করে নিয়ে না এলে চন্দ্রাহত আমি বিষাদকুসুমের মতো পড়ে থাকতাম নদীর ভিতর!

আরও এক চাঁদ ছিল শান্তিনিকেতনে। শ্রীসদন হস্টেলের চাতালের মাথায়, আম্রকুঞ্জে, ছাতিমতলার পাশের রাস্তা যেখানে উদ্যান বিভাগে গিয়ে মিশেছে, খেলার মাঠে, হাতিপুকুরের সিঁড়ির ধাপে, চিনাভবনের গলিতে। ‘ও আমার চাঁদের আলো’ গাইতে গাইতে, চাঁদের আলো শালমঞ্জরীর মতো গায়ে মাখতে মাখতে ভিড়ের মধ্যে একেবারে একা হয়ে যাচ্ছে কেউ। এই চাঁদের আলোয় বসন্তোৎসবের আগের রাতে আমি আর টুটুল নামের এক ছকভাঙা মেয়ে সারা রাত হু-হু হাওয়া আর শালপাতা খসার শব্দ শোনার জন্য চিনাভবনের সামনের কালভার্টে বসে থেকেছি! সে মেয়ে চলে গিয়েছে কোথায়! বিষাদসিন্ধু পেরিয়ে অচেনা কোনও অন্ধকারে চলে গিয়েছে! আর ওই অপার্থিব চাঁদের আলোয় যে ছেলের পাশে আম্রকুঞ্জে বসে থেকেছি, সেও গিয়েছে সেই একই পথে!

চাঁদ আছে চাঁদের মতো। কেবল বিষাদকুসুম নামে একদা অভিনেত্রীর মতো রোলে অভিনয় করে যেতে হচ্ছে আমাদের একের পর এক অকালগমনে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন