ধর্মেরও পাঠ দিচ্ছেন ‘মহারাজা’ অনন্ত

এত দিন নিজেকে বলতেন ‘মহারাজ’। তৈরি করে ফেলেছিলেন নারায়ণী সেনাও। এখন তাঁর নতুন পরিচয়, স্বঘোষিত ধর্মগুরু। ধর্মাচরণের উপরে বই তো লিখছেনই, সঙ্গে জারি করেছেন ফতোয়া।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৫৬
Share:

ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব

এত দিন নিজেকে বলতেন ‘মহারাজ’। তৈরি করে ফেলেছিলেন নারায়ণী সেনাও। এখন তাঁর নতুন পরিচয়, স্বঘোষিত ধর্মগুরু। ধর্মাচরণের উপরে বই তো লিখছেনই, সঙ্গে জারি করেছেন ফতোয়া। রাজবংশীরা কী ভাবে জীবনযাপন করবেন, কী মানবেন, কী মানবেন না, বলা আছে সেই ফতোয়ায়। সেই অর্থে ‘১, ২, ৩...’ করে জারি করা কোনও লিখিত ফতোয়া এটি নয়।। তা সত্ত্বেও উত্তরের রাজবংশী সম্প্রদায় অধ্যুষিত অনেক এলাকাতেই প্রায় মুখে-মুখে চাউর হয়ে গিয়েছে ‘অনন্ত মহারাজ’-এর সেই সব নির্দেশ।

Advertisement

সেই নির্দেশে কখনও অনন্ত বলেছেন, সন্ধ্যায় তুলসীতলায় পুজোর প্রয়োজন নেই। বলেছেন, অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তনও রাজবংশীদের জন্য ঠিক নয়। প্রয়োজন নেই কণ্ঠিধারণের। তাঁর উপদেশ, বাড়িতে আচার-অনুষ্ঠানে আর ব্রাহ্মণ পুরোহিত পুরোহিত ডাকার দরকার নেই। কাজটা সংগঠনের স্বীকৃত ‘অধিকারী’কে দিয়ে করাতে হবে। বিয়েতে টোপরের বদলে বরকে পাগড়ি পরতে হবে।

এমনই নানা ‘বাণী’র প্রচার চলছে জোরকদমে। অনন্ত রায় অবশ্য ‘ফতোয়া’ শব্দটিতে আপত্তি তুলেছেন। তাঁর যুক্তি, নিজের বইগুলিতে তিনি কিছু পরামর্শ দিয়েছেন মাত্র। তিনি বলেন, ‘‘আমি কিছু পরামর্শ দিই। ধর্মীয় বাণী শোনাই। কেউ ইচ্ছে হলে তা গ্রহণ করতে পারে। কোনও জোরাজুরি কিংবা ফতোয়ার ব্যাপার নেই।’’ যদিও বইয়ে তিনি বলেছেন, ‘আদেশ মতো কাম করিবেন/ না হইবেন ভিন্নমতি/ স্বপ্ন তোমার পূর্ণ হইবে/ সঙ্গে আছেন বিশ্বরথি।’

Advertisement

এই ঘটনা জানাজানি হতেই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে রাজবংশী সম্প্রদায়ের অন্দরে। কে নেই প্রতিবাদীদের তালিকায়! কেপিপি নেতা অতুল রায়, দুই গ্রেটার নেতা বংশীবদন বর্মন ও আশুতোষ বর্মা, পশ্চিমবঙ্গ রাজবংশী অ্যাকাডেমির সদস্য-সহ অনেকেরই অভিযোগ— গ্রেটার-নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েছিলেন অনন্ত। সে জন্য নারায়ণী সেনাও গড়েছিলেন। কিন্তু তাতে সুবিধার বদলে সমস্যাই হয়েছে বেশি। তাই এখন ধর্মগুরু সেজে অলিখিত ফতোয়া দিয়ে রাজবংশী সমাজের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে বিপন্ন করতে চাইছেন অনন্ত। কারও কারও আবার বক্তব্য, নারায়ণী সেনার কুচকাওয়াজের নামে প্রচুর টাকা তোলা হয়েছিল। এখন বিপাকে পড়ে সে সব দিক থেকে নজর ঘোরাতে চাইছেন অনন্ত। ধর্মগুরু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সে কাজ সহজ হয়।

অতুল রায় যেমন বললেন, ‘‘কখনও নারায়ণী সেনার নামে টাকা তোলা হচ্ছে। আবার কখনও ফতোয়া দিয়ে দাওয়ার তুলসী মঞ্চ তুলে দিতে বলা হচ্ছে। এ সব কি হচ্ছে! আমরা সম মনোভাবাপন্নরা একজোট হয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যকে জানাব। শীঘ্রই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইব।’’ তাঁর দাবি, ‘‘অনন্ত রায়ের কাজকর্ম সম্পর্কে বিশদে তদন্ত হওয়া দরকার।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘নারায়ণী সেনার টাকা কোথায় গেল?’’

রাজবংশীদের আর এক নেতা বংশীবদন বর্মন এখন পুলিশের উপরে হামলার মামলায় ফেরার। টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘ধর্মীয় ফতোয়া জারি করা নিয়ে অনেক কিছু আমারও কানে এসেছে। রাতারাতি কেউ শতবর্ষের রীতি পাল্টে দিতে চাইলে সমাজ তা মেনে নেবে না।’’ আর এক গ্রেটার নেতা আশুতোষ বর্মাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। বললেন, ‘‘আমাদের সম্প্রদায়ের উন্নতি, ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে আমাদের সমর্থন আছে। তা বলে ফতোয়া দিয়ে ধর্মাচরণ বন্ধের বিপক্ষে আমরা।’’

রাজবংশীদের ইতিহাস নিয়ে চারুচন্দ্র সান্যালের প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘দি রাজংশীজ অব নর্থ বেঙ্গল’-এ বলা হয়েছে, একটা সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধী হলেও কোচবিহারের রাজারাই পরে ব্রাহ্মণদের সাদরে বরণ করেছেন। এমনকী, বৈষ্ণবদেরও পৃথক জায়গা দিয়েছেন কোচবিহারের রাজারাই। এর ফলে যে রাজবংশীদের জীবনযাপনে অনেক বদল এসেছিল, সেটা মেনে নিচ্ছেন অনেক নেতাই। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, ১৯১৫ সালে রংপুর জেলায় ‘ক্ষত্রিয় সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করে রাজবংশীদের উন্নতির জন্য লড়াই শুরু করেছিলেন যে পঞ্চানন বর্মা, তিনিও কখনও ধর্মগুরু হতে চাননি। তবে অনন্ত চাইছেন কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন